হযরত মুহাম্মদ (সা.) : সৃষ্টিজগতের কল্যাণ ও শান্তির শ্রেষ্ঠ বার্তাবাহী

6

এমরান চৌধুরী

আজ ১২ রবিউল আউয়াল। সোমবার। মুসলিম জাহানের পরম আনন্দের দিন। এ মাসের এদিনে মা আমেনার কোল আলো করে এসেছিলেন আখেরি পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখনকার আরবের ঘোর অমানিশা তাড়িয়ে তিনি ধরণীর বুকে উপহার দিয়েছিলেন একটি নতুন ভোর। যে ভোরে তপ্ত বালুকারাশির বুকে নেমেছিল শান্তি আর অনাবিল আনন্দ। আমাদের জাতীয় কবি সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটিয়েছেন ঠিক এভাবে
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে \
কুল মাখলুকে আজি ধ্বনি ওঠে কে এলো ওই
কালমা শাহাদাতের বাণী ঠোঁটে কে এলো ওই
খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে কে এলো ওই
আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটে কে এলো ওই
পড়ে দরুদ ফেরেশতা বেহেশতের সব দুয়ার খোলে \
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নিখিল ধরিত্রীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবিব সম্পর্কে পবিত্র আল কোরআনে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ (সূরা আহযাব, আয়াত-২১)
নবীজির প্রতিটি বাণী সার্বজনীনতার আওতায় মুমিনগণ তো বটেই, এমনকি গোটা বিশ্ব, জীব-জন্তু, কীট-প্রতঙ্গ, নিসর্গ, সকল মাখলুকাত কল্যাণ ও শান্তির আশ্বাস পায়। তিনি সারা সৃষ্টি জগতের জন্য কল্যাণ ও শান্তির শ্রেষ্ঠ বার্তাবাহী, বিশ্বজগতের জন্য রহমত। এব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তো তাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ।’ (সূরাহ আম্বিয়া, আয়াত -১০৭)।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মহান চরিত্রের অধিকারী ও আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। জন্মের পর হতেই তাঁর মাঝে বিরাজ করেছিল সর্বোত্তম চরিত্র মাধুর্য, সর্বোত্তম আদর্শ, মহৎ মানুষ ও সর্বোত্তম প্রতিবেশি ইত্যকার মহত্তম গুণাবলি। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্বভাব ছিল কলুষতা, কাঠিন্য, কর্কশতা ও অহংকারমুক্ত। তিনি ছিলেন, দয়াশীল, শ্রদ্ধাশীল, সহানুভূতিশীল ও ঔদার্যশীল এবং নির্ভেজাল মহামানব। শৈশব থেকে তিনি সত্যবাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। তাই সেই শৈশবে অভিসিক্ত হন আল আমীন তথা বিশ্বাসী রূপে।
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল হয় পবিত্র আল কুরআন। তাঁকে পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম উপহার দিয়ে আল্লাহ পাক বিশ্ববাসীকে ডেকে বলেছেন, তার চরিত্রের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। আর ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে সকল ধর্মের সুন্দরতম গুণাবলির পূর্ণতম বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্যেও সকল নবী-রাসূলদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলির অভূর্তপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে।
মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে ছিল হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তত্তবা ও ক্রন্দন, হযরত নূহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর দাওয়াতী চরিত্র ও কষ্ট সহিষ্ণুতা, হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংগ্রামী জীবন ও পৌরুষ, হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর একত্ববাদ, ত্যাগ ও কুরবানী, হযরত ইসমাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছবর, সত্যবাদীতা ও আত্মত্যাগ, হযরত হারুন আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোমলতা, হযরত দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যাদুময় সুমিষ্টকণ্ঠ, শোকর ও সাহসিকতা, হযরত সোলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার জ্ঞান ও ঐশ্বর্য, হযরত সালেহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিনীত প্রার্থনা, হযরত এয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধৈর্য, হযরত ইউছুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৈহিক সৌন্দর্য, চারিত্রিক মাধুর্য, শোকর, ছবর ও সেনানায়কত্ব, হযরত ইউনুছ আলাইহিওয়াসাল্লাম-এর অনুশোচনা ও আফসোস, হযরত যাকারিয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কঠোরশ্রম, হযরত ইয়াহহিয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সরলতা, হযরত আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কঠোর ধৈর্য, হযরত যাকারিয়া, হযরত ইলিয়াছ ও হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়া ত্যাগ ইত্যাদি লক্ষ লক্ষ পয়গম্বরের লাখো বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহতায়ালা আখেরী রাসূলের আখলাকে হাছানার মধ্যে জমা করে দিয়েছেন। যেমন সকল নবী রাসূলের তামাম ছহিফা ও কিতাবসমূহকে আখেরি নবীর উপর নাযিলকৃত পবিত্র ধর্মগ্রন্থে সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন।
অপরিমেয় সাহস, সর্বোচ্চ ধৈর্য, অশেষ কৃতজ্ঞতা, অতুল ত্যাগ, দানশীলতা, নম্রতাসহ যত মানবিক গুণাবলি আছে সবগুলোর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত দোজাহানের পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পুর্ণাঙ্গ নৈতিকতার অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায় একমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে। তাই ঈমানী আলোক বর্তিকার অনুসন্ধানরত প্রতিটি মানুষের জন্য একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনই হিদায়াতের উৎস ও নাজাতের মাধ্যম।
পরম করুণাময় আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৪৫ ও ৪৬ সংখ্যক আয়াতে বলেছেন, ‘হে নবী ! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি (যুগে যুগে প্রেরিত নবী রসূলগণ যে তাঁদের উম্মাতের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন- এ কথার) সাক্ষীস্বরূপ এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর পথে আহবানকারী ও আলোকপ্রদ প্রদীপরূপে।’
উপযুক্ত আয়াতদ্বয়ে মহান আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি রাসূলুল্লাহর বিশেষ গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। এখানে নবীজির পাঁচটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১.সাক্ষীদাতা, তিনি কিয়ামতের দিন সকল উম্মতের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবেন। ২. সুসংবাদ প্রদানকারী, তিনি উম্মতগণের মধ্য থেকে সৎ ও শরিয়ত অনুসারী ব্যক্তিবর্গকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। ৩. সর্তককারী, তিনি অবাধ্য ও নাফরমান ব্যক্তিবর্গকে পরকালের আযাব ও জাহান্নামের সম্পর্কে সতর্ক করেন। ৪. তিনি স্বীয় উম্মতকে আল্লাহ পাকের সত্তা ও অস্তিত্ব এবং তাঁর আনুগত্যের প্রতি আহবান করবেন। ৫.তিনি মানব মন্ডলীকে আল্লাহপাকের দিকে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষেই আহবান করেন। এবং পঞ্চম গুণটি হচ্ছে, নবীজি ছিলেন জ্যোতিষ্মান প্রদীপ বিশেষ।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ক্ষমাশীলতার মূর্ত প্রতীক। মক্কাবাসী দীর্ঘদিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর চালিয়েছিল নির্মম নির্যাতন। এমনকি তাঁকে হত্যা করার জন্য ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যেতে। মক্কা বিজয়ের পর তিনি মক্কার লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা আমার থেকে কেমন ব্যবহার আশা করছ?’মক্কাবাসী উত্তরে জানাল, ‘আমরা আপনার কাছে দয়াপূর্ণ ব্যবহার প্রত্যাশা করছি। “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা মুক্ত স্বাধীন।”
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকেও ক্ষমা করে দিলেন। এই আবু সুফিয়ান ওহুদ যুদ্ধে কাফেরদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই যুদ্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় চাচা হযরত হামযা রাদিআল্লাহু আনহু শহিদ হয়েছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা গুরুতর অপরাধ করেছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
অমুসলিম লেখক উইলিয়াম হার্ট তাঁর ‘দ্য হান্ড্রেড’ গ্রন্থে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সবার আগে স্হান দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালীদের তালিকায় আমি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্হান দিয়েছি। আমার এ পছন্দ কোনো কোনো পাঠককে বিস্মিত করতে পারে। কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয়ক্ষেত্রেই সর্বাঙ্গীণ সাফল্য লাভ করেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিস্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর লিখেছেন, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁকে শুধু সে যুগের মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।”
এই হলো আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। দ্বীনের নবী। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব। যাঁর আবির্ভাবই হয়েছিল মানবজাতির হেদায়েতের জন্য। ভালো-মন্দ কাজের হিতাহিত জ্ঞানদানের জন্য। কীভাবে শত্রæকে আপন করা যায়, কীভাবে পথভোলা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া যায় তার জন্য। প্রিয় নবীজির আবির্ভাব দিনে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আজ সত্যই উচ্ছ¡সিত। জাতীয় কবির ভাষায় সে উচ্ছ¡াস প্রতিধ্বনিত হোক লক্ষ প্রাণে

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।
ধুলির ধরা বেহেশতে আজ
জয় করিল, দিল রে লাজ,
আজকে খুশির ঢল নেমেছে
ধূসর সাহারায়…

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক