হঠাৎ আলোচনায় জাতীয় সংগীত

3

আকতার কামাল চৌধুরী

একটি দেশের জাতীয় সংগীতে সেই দেশের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এমনকি গণমানুষের লড়াকু জীবনের ক্রমধারার উপাদান নিহিত থাকে। সে বিচারে আমাদের জাতীয় সংগীতে এ উপাদানগুলোর ঘাটটি লক্ষ্যণীয়। এতে বরং বাংলার ঋতুকেন্দ্রীক প্রকৃতির এক অপরূপ, অনবদ্য ও মনোলোভা বর্ণনা আছে। এই গানের মোঠো সুর একজন শ্রোতাকে অভিভূত করবেই। তাই রবীন্দ্রনাথের হাজারো গানের মধ্যে এই গানকে একটি নীরেট রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া অন্যকিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। কিন্তু, রবীন্দ্র সংগীত শুধু নামেমাত্র সংগীত নয়, একেকটা সংগীত একেকটা গভীর ভাব দর্শণসমৃদ্ধ কবিতা। তারপরও জাতীয় সংগীত তো কোরানের আয়াত (বিশ্বাস মতে) নয় যে কোনোকালেই এর একটি অক্ষরও পরিবর্তনীয় নয়। কালের পরিক্রমায় যেটা যাচিত এখন তা অযাচিত বিবেচিত হতেই পারে। মায়ের সাত ছেলে তাদের মাকে সাত রঙের শাড়ি পরিয়ে যাচাই করতে পারে কোন শাড়িতে তাদের মাকে মানানসই লাগে। এতে দোষের কী আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয় বাংলাদেশ, এমনকি পাক-ভারত স্বাধীনতা লাভ করার আগেই। তাই, এই গানে ‘বাংলাদেশ’ শব্দ থাকার কোনো কারণও ছিল না। গানটি লিখেছিলেন একটি লালন সংগীতের সুর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে। তাঁর সহজাত কবিসত্তা থেকেই তিনি এ গানটি লিখেছিলেন। কোনো দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নয়। কবির জীবদ্দশায় যেহেতু পাক-ভারত স্বাধীন-ই হয়নি, সেই বিবেচনায় অখন্ড ভারতের কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের কবিও বলা চলে।
বৃটিশ থেকে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রবী ঠাকুরের একটি গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেন। এদিকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সরকারও একই কবির ‘আমার সোনার বাংলা গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু কথা থেকে যায়, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারি এ গানকে জাতীয় সংগীতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও মূলত ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে এ গানটি অত্যন্ত স্বার্থকভাবে রুপায়ন করা হয়। বাংলার অপরূপ প্রকৃতির মাঝে এক অসাধারণ সুরের সাথে সমবেত কণ্ঠের সারল্যে ভরা এই চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণ এখনো দর্শকদের মনে দাগ কাটে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যখন ‘হিন্দুর রচনা’ বলে রবীন্দ্র সংগীতের উপর খড়গহস্ত, তখনও পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানাদীর অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিল এই গান। অর্থাৎ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রাতারাতি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ অমুসলিম বলেই কি তাঁর রচিত গানকে জাতীয় সংগীত থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলছেন? আরে ভাই, ২০২৪ সালের আধুনিক যুগে এসে- যখন কি না মানবজাতির চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ যেখানে নিজেকে গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা ভাবতে শুরু করেছে, তখন হিন্দু তক্মা একেবারেই বেমানান, একেবারেই কদর্য, এমনকি আপত্তিকরও। কোনো কবি-সাহিত্যিক হিন্দু-মুসলিম পরিচয়ে সাহিত্য রচনা করেন না। রচনা করেন মানুষ পরিচয়ে। রবি ঠাকুরের লেখা পড়ে তাঁকে আমি একটা ফ্রেমে বাঁধার চেষ্টা করেছি। সেই ফ্রেমে আমি তাঁকে ‘হিন্দু’ হিসেবে নয় বরং ‘মানুষ’ হিসেবেই পেয়েছি। বলতে গেলে প্রচলিত ধর্মকর্মে তাঁর কোনো বিশ্বাস-ই ছিল বলে মনে হয়নি। তাঁর অজগ্র লেখার মধ্যে ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’, ‘হৈমন্তী’ পড়লে বোঝা যায় তিনি আদৌও কোনো ‘হিন্দু’ না কি ‘মানুষ’। এপার-ওপার বাংলার সাহিত্য-সঙ্গীতকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সেই কথিত ‘হিন্দুরা’। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকেও তাঁদের লেখা অযাচিতভাবে নয়, শিল্পগুণেই স্থান পেয়েছে। আমরা দিনরাত তাঁদের রচিত গল্প­উপন্যাস পড়ি; তাঁদের সুরে ও কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে থাকি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র বলে অন্য জাতিগোষ্ঠীর সৃজনশীলতাকে এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই।
একবার ভাবুন, ইলেক্ট্রিসিটি, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট, মাটির কয়েক কিলোমিটার নিচে লুকিয়ে থাকা খনিজ সম্পদের রহস্য উন্মোচন, মসজিদ- ইসলামি মাহফিলে ব্যবহৃত মাইক, এ-রকম অসংখ্য জনহিতকর প্রযুক্তি কাদের হাত ধরে এসেছে। কিংবা এর সুফলভোগীও-বা আজ কারা। জমজম কুপ থেকে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পানি উত্তোলনের কাজে ‘জমজম স্টাডিজ এন্ড রিচার্চ সেন্টার’ নামের যে প্রতিষ্ঠান- সেই প্রতিষ্ঠানের আধুনিক যন্ত্রপাতি কাদের তৈরী। কোন ব্যক্তি যখন কোনো গোষ্ঠী থেকে অযাচিত নিগ্রহের শিকার হন, নিষ্ঠুরতার শিকার হন, সেই নিষ্ঠুরতা নিগ্রহতা যখন সবকিছুকে ছাপিয়ে জীবনের অনেককিছু কেড়ে নিয়ে যায়, তখন তাঁর কাছে সমাজের অনেককিছুর প্রচলিত সংজ্ঞাকে পানসে মনে হয়।
এমন ঝড়, এমন নৃশংসতা যার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যায় তিনি ছাড়া এর মর্মযাতনা অন্য কারো পক্ষে বোঝা অসম্ভব। তাই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তিনি মানসিক ট্রমার মধ্যে ডুবে যান। এই নৃশংসতার জন্য যে গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়, সেই গোষ্ঠীর কোনো নীতিকথা, এমনকি যুগান্তকারী কোনো সাফল্যকেও তাঁর কাছে একদম ফিকে লাগে। এগুলোর জন্ম হয় মানব মনের চরম হতাশা, প্রচন্ড রাগ-ক্ষোভ, গ্লানি থেকেই।
এক ভয়াবহ, অনিশ্চিত জীবন থেকে ফিরে আসা মানুষকে তাই অপরাধী সাব্যস্ত করা অনুচিত এবং অনৈতিকও। তাঁর মানসিক যন্ত্রণাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আরও বিবেচনায় নিতে হবে কবরের নিরবতায় দিন-রাতের পার্থক্য না-বুঝতে পারা এক বিভীষিকাময় দম বন্ধ করা পরিবেশে মৃত্যুর আশংকায় থাকা একজন সংসারী মানুষের প্রতিটি ক্ষণ কীভাবে কেটেছে। আহা! মাথায় কতো হাজারো প্রশ্ন প্রতিদিন! তাঁর পিতা-মাতা কি এখনো জীবিত আছে? তাঁকে কোথায় কোথায় খুঁজছে স্বজনেরা? ছোট বাচ্চাটা এখন দেখতে কেমন হয়েছে? তাঁর স্ত্রী কি একা সংসার সামলাতে পারছে? আহা, বেচারি কি প্রতিদিন চোখের পানি মুছবে, না কি সংসার সামলাবে! না কি আরও একটি দুঃসহ পরিণতির আশংকায় বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যাংকে থাকা টাকাগুলো কি তুলতে পেরেছে? হয়তো পারেনি। মৃত্যু সনদ ছাড়া ওয়ারিশুগণ তো এই টাকা তুলতে পারার কথা নয়। চেয়ারম্যান – কমিশনারও কীভাবে সনদ দেবেন, তাঁরাও তো জানেন না, আমি জীবিত না কি মৃত। সর্বোপরি, আমার নাম শুনলে তাঁরা কি আদৌও কোনো সনদ ইস্যু করবে? এরকম আরও কত প্রশ্ন। নিজেকে তাঁর যায়গায় রেখে একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো! কিন্তু না, ‘আমার সোনার বাংলা’-ই আমার জাতীয় সংগীত। এই গানের সাথে আমার প্রেম অশৈশব, সেই সবুজ সাথী বুকে নিয়ে ক্লাস ওয়ানের অ্যাসেম্বলি থেকেই। এই গান আমার অন্তরে খোঁদাই করা।
নারী-পুরুষের সমবেত কণ্ঠে গানটি যখন শুনি, হৃদয়ে একটা শিহরণ জাগে, পুরো দেশের মানচিত্র চোখের উপর ভেসে উঠে, আবেগে অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠে দুচোখ।’যাঁর লেখা-ই হোক, গগন হরকরার সুরের আদলেই হোক, যত অসংগতিই থাকুক- ‘আমার সোনার বাংলা’ই আমার জাতীয় সংগীত। এই গানের প্রতিটি শব্দ আমার রক্তের কণিকায় মিশে আছে। চাইলেও কেউ এটি আমার রক্ত থেকে আলাদা করতে পারবে না। এই গানকে আমি আমার মায়ের মতোই ভালোবেসে ফেলেছি। এই গান আমার সন্তানের মত-ও। আমরা কোনো ব্যক্তিবর্গের মানসিক নিপীড়নের সমব্যথী হতে পারি কিন্তু দেশের মিমাংসিত বিষয় নিয়ে তাঁর মানসিক ট্রমা থেকে উৎসারিত নীতির সাথে একমত হতে পারি না।
লেখক : প্রাবন্ধিক