যৌতুক বিরোধী আন্দোলন অনুসরণীয় কর্মসূচি

15

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

অপসংস্কৃতির যিনি সংস্কার করেন তিনি সংস্কারক। যৌতুক প্রথা একটি অপসংস্কৃতি। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর মেয়েরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয় না বিধায় বিয়ের সময় সম্পত্তির কিছু অংশ দিয়ে থাকে। মুসলিম মেয়েরা অনেক দিক হতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার পরও কেন একটি কুপ্রথা ‘যৌতুক’ প্রদান করতে হবে ! যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি ও কুসংস্কারকে সংস্কার করতে সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করছেন বলেই আল্লামা আবুল কাশেম নূরী একজন সমাজ সংস্কার বলে আমি মনে করি।
আল্লামা নূরী সাহেব হুজুর আমার শিক্ষক। তিনি শিক্ষা দেননা ছাত্রদের ভিতরে ভিতরে নির্মাণও করেন। তিনি আমাদের গর্বকরার মত একজন শিক্ষক।
কিছু আলেম সমাজের কথার সাথে কাজের মিল না থাকায় একশ্রেণীর মানুষ বলে থাকে ‘ আজকের আলেমদের ও সিয়াত শোনয়, খাসিবত দেখনা ’। আল্লামা নূরী এধরণের কথার উচিৎ জবাব দিয়েছেন, কথা ও কাজের মাধ্যমে। তিনি নিজে যৌতুক গ্রহণ করেননি, জীবনে প্রচুর যৌতুক মুক্ত বিয়ে সম্পাদন করেছেন এবং যৌতুকের অভিশাপ হতে মুক্তির সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁর এই আন্দোলন সকল আলেম ওলামাদের কাছে একটি অনুসরণীয় কর্মসূচি বলে আমি মনে করি।
অন্ধকারকে তাড়াতে হলে লাঠিপেটা করে তাড়ানো যায় না, আলো দিয়ে তাড়াতে হয়, আল্লামা নূরী একজন সমাজে আলোকিত মানুষ। তাঁর জীবন ইসলামের আলোকিত সামাজিক অন্ধকার দূর করতে উৎসর্গকৃত। একজন মনীষী বলেছেন, ‘ঐ যুদ্ধই প্রকৃত যুদ্ধ যে যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না’। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংস্কৃতির যুদ্ধ, অশিক্ষার বিরুদ্ধে শিক্ষার যুদ্ধ, অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না। হুজুরের এই আন্দোলনে কেউ পরাজিত হবে না এবং বিজয়ী হবেন। একদিকে আমি পুত্রের পিতা হিসাবে যৌতুক নিচ্ছি। আবার অন্যদিকে আমাকে কন্যা বিয়ে দেওয়ার সময় যৌতুক প্রদানে রিক্ত হচ্ছি। যৌতুকের মত কুপ্রথাটি আমরাই সৃষ্টি করছি। লোভের কারণে প্রথাটির সৃষ্ট। যে লোভের কারণে একুশ শতকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির কালে অপমাণিত হচ্ছে সমাজ। মহান আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন মানুষ সৃষ্টির সেরা ? তার উত্তরে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘কুন্তু খায়রা উম্মাতি উখরিজাত লিল্লাস্ তা’মুরুনা বিল মারুফ ওয়া তান্হাউনা আনিল মোনকার’। অর্থাৎ তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি করা হয়েছে যাতে তোমরা মানুষের কল্যাণ কর, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষধ কর।
যৌতুক একটি অকল্যাণকর কুপ্রথা। এ প্রথাটি যারা গ্রহণ করে তারা সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারে না এবং এই অসৎ কাজটিতে বাধা দেওয়া ঈমানী দায়িত্ব। সে ঈমানী দায়িত্ব পালনে আল্লামা নুরী (মা. জি. আ) মাঠে নেমেছেন। একুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর পিছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যদি সমাজে কেউ অন্যায় কাজ করে তাতে যেন শক্তি দিয়ে বাধা দেয়, তা সম্ভব না হলে যেন কথার মাধ্যমে প্রতিবাদ করে, আর যদি তাও সম্ভব না হয়, অন্তরে যেন ঘৃনা করে। শেষ কাজটি দুর্বলতম’। (স্হীহ বোখারী)
অথচ আমরা যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধিটির প্রতিরোধ, প্রতিবাদ তো দূরে অন্তরে ঘৃণাও করছি না বরং আনন্দের সাথে গ্রহণ করছি।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো না। (সূরা : ৫, আয়াত : ২)
যৌতুক নামক পাপ কাজটির বিরুদ্ধে আল্লামা আবুল কাশেম নূরীর সংগঠন আন্জুমানে রজভীয়া নূরীয়া ট্রাস্ট বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রতি বছর ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে, ‘যৌতুক বিরোধী আইনের প্রয়োগ চাই, যৌতুক মুক্ত সমাজ চাই, বর যাত্রী খাওয়া বন্ধ কর ওয়ালিমা প্রথা চালু কর, নবীর (দ.) সুন্নাত কায়েম কর’ এই শ্লোগান বুকে ধারণ করে অনুষ্ঠিত হয় মহাসমাবেশ। গত ৬ বছর তিনি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। মানব মানে ব্যাপক সাড়া পড়লেও সরকার যৌতুক বিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগে এখনো করেনি। আল্লামা নূরী বলেন, যৌতুক মুক্ত দেশ গড়তে আমি সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। আশানুরূপ সাড়াও পেয়েছি।
এ আন্দোলন বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী বলে মানব হৃদয়ে দাগ কেটেছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি এক ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। কারণ নির্যাতিত জনতার পক্ষে তিনি দাঁডিয়েছেন।
হাজার বছরের সমৃদ্ধ সোনার বাংলা যৌতুকের কারণে নরকে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে আমরা দেখতে পাই, যৌতুকের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকান্ড। প্রতি বছর এসিড দ্বারা পুড়িয়ে হত্যা আত্মহত্যা এবং সাধারণ হত্যায় মরছে ৩ শতের কাছাকাছি মানুষ। কখনো কখনো পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই, ‘ যৌতুকের দাবি পূরণ না হওয়ার ২০ হাজার টাকায় স্ত্রী বিক্রয়, অন্তঃসত্ত¡া স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য হত্যা; ‘যৌতুকের দাবি পূরণ না হওয়ায় বিয়ে ভঙ্গ, ‘যৌতুক না পাওয়ায় স্বামী স্ত্রীর শরীরে গরম পানি ঢেলে শরীর ঝলসে দিয়েছে, ‘যৌতুক না দেওয়ায় বিয়ে আসরে হামলায় পনের জন আহত’। যৌতুকের কারণে এ ধরনের ঘটনা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ এ ধরনের অসামাজিক কর্মকাÐের বিরুদ্ধে আলেম ওলামা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিবেকবান মানুষ তীব্র কোন আন্দোলন বা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেনা। এ কুপ্রথাকে নিয়ম হিসেবে মেনে নিচ্ছে। এমনি সময় যৌতুকের অভিশাপ হতে দরিদ্র পরিবার ও সমাজকে মুক্ত করতে মাওলানা নূরী একটি গ্রহণযোগ্য আন্দোলন সৃষ্টি করছে। তিনি ঘোষণা করেছেন ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি এ আন্দোলন চালিয়ে যাবো,। তিনি আরো দাবি করেছেন, যৌতুক প্রতিরোধে সরকারি ভাবে স্থায়ী ম্যারেজফান্ড গঠন করতঃ সে ফান্ড থেকে দরিদ্র যুবকদের সুদমুক্ত ঋণের প্রদানের। নূরী সাহেব হুজুর একজন অভিজ্ঞ আলেম এবং শরীয়ত ও তরীকতের একজন খেলাফতপ্রাপ্ত পীর। সুন্নিয়তের জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। সুন্নিয়ত নিয়ে তিনি ব্যবসা করে সুন্নিয়তকে অপমানিত করেননি। তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছেন যে, প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোন আদর্শ টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই তিনি কুসংস্কার মুক্ত খাঁটি সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় ১৪টি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।
যৌতুক বিরোধী আইন প্রয়োগ, প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নে আজ সময়ে দাবি। এটি কোন ব্যক্তিগত আবদার বা চাওয়া পাওয়া নয় এটি একটি ঈমানী দায়িত্ব। এই ঈমানী দায়িত্ব কেউ পালন না করলে সব মুসলমান গুনাহগার হবে।
বর্তমান সমাজে অধিকাংশ মুসলমান স্ত্রীর অধিকার ‘মোহরানা’ আদায় করে না। যে মোহরানা আদায় না করলে বিয়ে বৈধ হয় না। অথচ বিপরীতে শ্বাশুর বাড়ীর যৌতুক গ্রহন করে। অন্যদিকে বাপের সম্পত্তির মধ্যে কন্যার নির্ধারিত অংশ অধিকাংশ মানুষ প্রদান করে না। বরযাত্রী খাওয়া বৈধ না হরেও আয়োজন করছি, আবার বরের পক্ষে অলিমা খাওয়া সুন্নাত হলে তা ত্যাগ করছি। অর্থাৎ ইসলাম আমাদের ওপর যা কর্তব্য করছে তা আমরা পালন করছি না এবং উল্টো যা নিষেধ করছে তাই করে যাচ্ছি। এসব বিষয় রাষ্ট্রীয় ভাবে তুলে ধরতে আল্লামা নূরী সাহেব হুজুর যে কর্মসূচি গ্রহণ করছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং শিক্ষিত সমাজের নিকট গ্রহণ যোগ্য। আমাদের প্রার্থনা, আল্লাহ পাক যেন তাঁকে নিপীড়িত, নির্যাতিত, দলিত-মথিত, শোষিত মানুষের পক্ষে কাজ করতে সুস্থ শতায়ু করে। আমিন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক