চট্টগ্রামে লাখো মানুষ পানিবন্দী

6

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাদ্রের শুরুতে টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে দেশের কয়েকটি জেলার মত চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত জনপদ বন্যাকবলিত হয়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশঃ অবনতি হচ্ছে। হালদা ও মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়ছে কর্ণফুলী, ইছামতি ও সাঙ্গুর পানিও। স্থানীয় সূত্র ও জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর নিম্নাঞ্চল ছাড়াও তিন উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই লাখেরও বেশি মানুষ। এর বাইরে আরও বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
উজান থেকে নেমে পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিতে গত বুধবার থেকেই নগরীর ব্যাপক জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কয়েকটি উপজেলা প্লাবিত হতে শুরু করে। আগের দুদিনের মত গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টানা অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, জেলার ফটিকছড়ি, মিরসরাই ও সীতাকুন্ড উপজেলায় এক লাখ ষাট হাজার মানুষ এ মুহূর্তে পানিবন্দি আছেন। এর মধ্যে ফটিকছড়ি ও মিরসরাইয়ে বন্যাকবলিত গ্রামের সংখ্যা বেশি। তিন উপজেলায় একশ’ ১২টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া রাউজান, হাটহাজারী ও বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামও প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও আশপাশের অঞ্চলে একশ’ ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় একশ’ ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শুক্রবারও ভারি বৃষ্টিপাতের ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এতে করে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের শঙ্কাও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ভারি বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, মেহেদীবাগ, চকবাজার, বাকলিয়া ডিসি রোড, জিইসি, প্রবর্তক মোড়, তিন পোলের মাথা, হালিশহরসহ বেশকিছু এলাকা ডুবে গেছে। টানা বৃষ্টির সাথে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানি হালদা ও মুহুরী নদী উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে ফটিকছড়ি,সীতাকুন্ড মিরসরাই, রাউজান ও হাটহাজারীর বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমুন নবী বলেন, তাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে চট্টগ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনটি উপজেলা মূলত সরাসরি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এগুলো হচ্ছে, সীতাকুÐ, মিরসরাই ও ফটিকছড়ি। তিনটি উপজেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পঞ্চাশ মেট্রিকটন ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। একশ’ ৩৭টি মেডিকেল টিম বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে। এছাড়া দুইশ’ ৩৯টি স্বেচ্ছাসেবক টিম দুর্গতদের সহায়তায় কাজ করছে। বন্যাকবলিত তিনটি উপজেলার মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে তিন হাজার একশ’ ৭৫ পরিবার, মিরসরাই উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২ হাজার পরিবার এবং সীতাকুন্ড উপজেলায় ৬টি উপদ্রুত ইউনিয়নে পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। শহরে এবং উপজেলায় পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের সরে যাবার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সতর্ক আছি। চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলা বন্যা কবলিত। এরমধ্যে মিরসরাই ও ফটিকছড়ির বন্যা পরিস্থিতি একটু খারাপ। বন্যার পানিতে সর্বশেষ হিসাব মতে প্রায় ৪৬ হাজার পরিবারের দুই লক্ষ ৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে। মিরসরাই ও ফটিকছড়িতে ৩৫টি নৌযান উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে মিরসরাই ও ফটিকছড়িতে খুলে দেয়া ৮৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গঠন করা হয়েছে ১১৬টি মেডিকেল টিম।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত ফটিকছড়ি, মিরসরাই, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, কর্ণফুলী, পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী ও রাউজানের বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে। এসব উপজেলার ৯৩টি ওয়ার্ডের ৪৫ হাজার ৯১৬ পরিবারের দুই লক্ষ ৪ হাজার ৮৫০ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে। এরমধ্যে ফটিকছড়ির ২০ ওয়ার্ডের ১৯ হাজার ৫৮০ পরিবারের ১ লক্ষ ২ হাজার মানুষ, মিরসরাইয়ের ১২ ওয়ার্ডের ১২ হাজার পরিবারের ৪৮ হাজার ৫০০ মানুষ, সীতাকুন্ডে ৬ ওয়ার্ডের ৫ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ, হাটহাজারীর ৮ ওয়ার্ডের ১২০ পরিবারের ২ হাজার ৮০০ মানুষ, কর্ণফুলীর ৫ ওয়ার্ডের ১০০ পরিবারের ৫০০ মানুষ, পটিয়ার ১৮ ওয়ার্ডের ৬ হাজার ৯৪৬ পরিবারের ২০ হাজার মানুষ, বোয়ালখালীর ৩ ওয়ার্ডের ১০০ পরিবারের ৭০০ মানুষ, বাঁশখালীর ৮ ওয়ার্ডের ১ হাজার ৭৫০ পরিবারের ৮ হাজার ৭৫০ মানুষ, রাউজানের ১৩ ওয়ার্ডের ৩২০ পরিবারের এক হাজার ৬০০ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ১০-৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বন্যা মোকাবেলায় মিরসরাইয়ের ৭৯টি ও ফটিকছড়ির ৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মিরসরাইয়ের ৭৯টি কেন্দ্রে ২১৭ জন পুরুষ, ১৯৫ জন মহিলা, ৮৮ জন শিশু এবং ফটিকছড়ির ৫টিতে ৪২০ জন পুরুষ, ৪৮০ মহিলা, ৪০৫ জন শিশু ও ২৫ জন প্রতিবন্ধী লোক আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও মিরসরাইয়ের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৬২টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যা কবলিত রাউজান ছাড়া বাকি ৮ উপজেলায় গঠন করা হয়েছে ১১৬টি মেডিকেল টিম। যারমধ্যে ১১১টি চালু করা হয়েছে। মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
ফটিকছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি একটু খারাপ। ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমরা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক অবস্থায় আছি।
উপজেলা থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফটিকছড়ি উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে আছে। ফসলের ক্ষেত, পুকুর, মাছের খামার তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উত্তর ফটিকছড়ির হেঁয়াকো রামগড় সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মিরসরাই উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে পানি উঠে গেছে। উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের হিঙ্গুলী, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মিরসরাই পৌরসভা, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, খৈয়াছড়া, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বারইয়ারহাট-রামগড় সড়ক ও জোরারগঞ্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়ক প্লাবিত হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সীতাকুন্ড উপজেলার উত্তরের ছয়টি ইউনিয়ন। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সিকদার খালের স্লুইসগেট। এতে লোকালয়ে পানি ডুকে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এছাড়া রাউজান উপজেলার পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, মাহালদারপাড়া, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা ও বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়াসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হাটহাজারী উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার মধ্যে রয়েছে বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী। বোয়ালখালী উপজেলার কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম, উপজেলা সদর, এবং সারোয়াতলী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীতে প্রবল স্রোত থাকায় কালুরঘাটে ফেরি চলাচল দুইদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে সাধারণ লোকজনের গন্তব্যে যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে দুইশ’ ৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জেলার দুইশ’ ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট দুইশটি, ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রত্যেকটিতে পাঁচটি করে মোট ৭৫টি, নয়টি আরবান ডিসপেন্সারির প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট নয়টি, স্কুল হেলথ ক্লিনিকে একটি এবং জেলা সদর হাসপাতালে (জেনারেল হাসপাতাল) পাঁচটিসহ সর্বমোট দুইশ’ ৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ওষুধ, স্যালাইন, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ আছে। এরই মধ্যে মেডিকেল টিমগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।