আহতদের কেন সন্তান-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হচ্ছে?

5

‘২০২৪ সালে এসে অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সবাইকে হাতজোড় করে অনুরোধ জানাই, আহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিন। আহত ব্যক্তিদের কেন সন্তান, সম্পদ, গয়না বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হচ্ছে?’ শরীর আর মনে বেদনা নিয়ে কথাগুলো বলেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গুলিতে এক চোখ হারানো সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ (২৩)। চট্টগ্রামে অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তার মতো সেখানে হাজির হয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, আহত ব্যক্তি ও আন্দোলনে যুক্ত থাকা শিক্ষার্থীরা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি জানান। বক্তব্য চলাকালে চোখ ভিজে ওঠেছিল উপস্থিত সবার।
‘ওদের ভাবনায় বাংলাদেশ’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) মিলনায়তনে। জুলাই-আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন হত্যাকান্ড, নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ জানাতে অভিভাবক হিসেবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে এই প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয় বলে জানান আয়োজকেরা।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন সদস্য রাখাল রাহা। এই প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য ও নীতিমালা তুলে ধরেন ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ এর সদস্য আসফিয়া আজিম। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন ছাত্রছাত্রী, যুবক, তরুণ ও শিশুদের সংহতি থেকে জন্ম নিয়েছে। সেখানে আমাদের অবস্থান ছিল সহায়ক, সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামূলক। আগামী দিনেও সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় থাকবে এই প্ল্যাটফর্ম।’
আরেক সদস্য দলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কয়েকবার সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে তারা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
গত ১৮ জুলাই উত্তরায় বুলেটে নিহত হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। অনুষ্ঠানে তার খালাতো বোন ফারহানা সুলতানা বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন গণভবনে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো মুগ্ধ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধদের মতো যারা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। অপরাধীদের যেন বিচার হয়।
গত ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে পুলিশ লাইনসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারানো তরুণ সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদকে এখন অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে হয়। তিনি অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। সময় চলে গেলে আর কিছু করার থাকবে না।’ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, চোখের জন্য এক হাসপাতাল, নার্ভের জন্য এক হাসপাতাল, হাঁটতে পারি না, সে জন্য আরেক হাসপাতাল। এই অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হয়। সরকার যদি প্রতিটি হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ইউনিট করে সমন্বিত চিকিৎসা দেয়, তাহলে আহত ব্যক্তিরা উপকৃত হতেন।
বনশ্রী আদর্শ নিকেতন স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আহত মো. নেসারউদ্দিন বলেন, আন্দোলনের সময় আহত ব্যক্তিদের ঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অনেকের হাত-পা কেটে ফেলা হয়েছে। তাকেও বলা হয়েছিল, ‘পা রাখবেন, নাকি কেটে ফেলবেন? পা কেটে ফেলে দিলে দ্রæত সুস্থ হতে পারবেন।’ সেসব কথা মনে পড়লে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সবাই আমাদের পাশে দাঁড়ান।’
রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যার দৃশ্য কাছ থেকে দেখেছেন তার সহযোদ্ধা সুবর্ণা বর্মণ। তিনি বলেন, ‘সেই ১৬ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত রাতে ঘুমাতে পারি না।’ আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন।
শান্তিতে ঘুমাতে না পারার কথা বললেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মেহরাব সিফাত বলেন, পরিস্থিতি যেন এমন না হয় যে আহত ব্যক্তিরা নিজেদের অবহেলিত ভাবেন।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মারুফ। তিনি বলেন, ‘একদল ইতর শ্রেণি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ভ্রুক্ষেপ না করে চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে। সরকারের প্রতি প্রশ্ন, কেন তারা এসব ম্যানেজ করতে পারছেন না।’
হতাহত ব্যক্তিদের নির্ভুল তথ্য তৈরির ওপর জোর দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা না গেলে তাদের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যাবে না।
অনুষ্ঠানে আহত তরুণদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন মো. আকাশ, আতিকুল ইসলাম, মো. মুস্তাকিম। তাদের কারও এক পা বা কারও এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোহেল আহমদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, ইডেন মহিলা কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শাহীনুর সুমি, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র উৎসব সিদ্দিকী, আহত দিনমজুর শাহীন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জাহিন ফেরদৌস, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাগিব সাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসমাইল রাকিব। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের দুই সদস্য সারা আফরিন ও কাজী সামিও শিশ।