আরব বসন্ত থেকে বাংলা বসন্ত

7

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(১ম র্পব)
আলোচনার শুরুতে নিম্নের সংবাদচিত্র তিনটির প্রতি পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : ক) ‘মিশর, লিবিয়া ও তিউনিশিয়ার মতো ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলন বাংলাদেশেও আমদানী করে সরকার ফেলে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরী করার জন্য বিরোধী দলগুলো যে চেষ্টা চালাচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সে কথা আগেই জানিয়েছিল (সময়নিউজ ডট কম, ১০-১২-২৩)।’ ক) ‘বাংলাদেশে আরব বসন্ত নয়, হবে বাংলা বসন্ত (জুনাইদ সাকী, প্রধান সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন, যমুনা টিভি, ১৯-১২-২৩)।’ খ) ‘রাশিয়ার পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোবার বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল মার্কিনীদের পছন্দসই না হলে নির্বাচনের পরে বাংলাদেশে ‘আরব বসন্ত’ এর মতো বিদ্রোহ ঘটানোর পাঁয়তারা করছে ওযাশিংটন। বাংলাদেশে সংঘটিত নাশকতামূলক ঘটনাসমূহের সাথে পিটার হাস এর বর্তমান কর্মকান্ড দায়ী বলে মনে করি (এটিএন নিউজ, ২০-১২-২৩)।’

উল্লিখিত সংবাদচিত্রসমূহের বিশ্লেষণে যে তথ্যসমূহ পাওয়া যায় : (১) বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল মার্কিনীদের পছন্দসই না হলে নির্বাচনের পরে বাংলাদেশে ’আরব বসন্ত’ এর মতো বিদ্রোহ ঘটাবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে মার্কিনীরা।(২) বিগত ডিসেম্বর, ২০২৩ বাংলাদেশে যে সব নাশকতামূলক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছিল সেগুলোর সাথে সে সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকান্ডের যোগাযোগ ছিল।(৩)সে সময় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনাইদ সাকীর ভাষ্য ও ভবিষ্যৎবানী অনুযায়ী উল্লিখিত আরব বসন্তের মতো বিদ্রোহ বাংলাদেশে সংঘটিত হলে তার নাম হবে ‘বাংলা বসন্ত’।(৪) গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও আগেই জানিয়েছিল যে,মিশর, লিবিয়া ও তিউনিশিয়ার মতো ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলন বাংলাদেশেও আমদানী করে সরকার ফেলে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরী করার জন্য বিরোধী দলগুলো চেষ্টা চালাচ্ছে।
উপরোক্ত তথ্যসমূহের উপর ভিত্তি করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, বিগত নির্বাচনের ফলাফল মার্কিনীদের পক্ষে যায়নি এটা যেহেতু সর্বজনবিদিত সেহেতু ধরে নিতে হয় যে বর্তমান ছাত্র আন্দোলনকে নাশকতামূলক রূপ দেয়ার পেছনে সিআাইএ এর হাত আছে। ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল কোটার বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে নয়। ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্বতস্ফুর্তভাবে, কারো ইন্ধনে নয়। নাশকতামূলক কর্মকান্ড কখনও ছাত্ররা করতে পারে না। এগুলো বাইরের নেতৃত্বে বাইরের প্রশিক্ষিত এজেন্টদের কাজ ছিল। যেমন, আমরা জেনেছি বিগত ডিসেম্বর, ২০২৩ যেসমস্ত নাশকতামূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলোতে মার্কিনীদের হাত ছিল। এই ছাত্রবিদ্রোহ সংঘটিত করার প্ল্যান যে ডিসেম্বর ২০২৩ এ নেয়া হচ্ছিল তার আরেকটা প্রমান হচ্ছে সে সময়কার গনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনাইদ সাকীর ভাষ্য। যাতে তিনি বলেছিলেন এ বিদ্রোহের নাম হবে ’বাংলা বসন্ত’ যা ছিল ‘আরব বসন্ত’এর সরাসরি অনুকরন। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি ’আরব বসন্ত’ এর অনুকরণে এ আন্দোলনের বøু প্রিন্ট তৈরী করেছিল সিআইএ। আমরা আরব বসন্ত ও বাংলা বসন্তের তুলনামূলক আলোচনায় যাবার আগে সম্মানিত পাঠকবৃন্দের কাছে চারটি
বিষয় পরিষ্কার হওয়া চাই : (১) বাংলাদেশ কেন পরাশক্তিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলো (২) হাসিনা সরকার কেন পরাশক্তিদের কোপানলে পড়লো ? (৩) ছাত্রদের আন্দোলন বেহাত হলো কেন ও কিভাবে ? (৪) আরব বসন্ত কি এবং বাংলা বসন্ত কি ?

বাংলাদেশ কেন পরাশক্তিদের আগ্রহের কেন্দ্র হলো ?
যুক্তরাষ্ট্রের মূল পরিকল্পনা হচ্ছে সামরিক কৌশলগত আকাক্সক্ষা পূরন করা। যদি কখনও যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে তাহলে একসংগে চীন ভারত সহ বহু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বাংলাদেশে আইএসআই এর কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে ভারতের নর্থ-ঈস্ট এ অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।ভারতের জন্য এটা গভীর উদ্বেগের কারন। পাকিস্তান এই সুযোগটা হাতছাড়া করবে না।আমেরিকা এমনভাবে প্ল্যান সফল করেছে বাংলাদেশের সাথে ভারতকেও যাতে অস্থিতিশীল করা যায়।কারন সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফর করেছেন যেটা আমেরিকার পছন্দ হয়নি। আমেরিকা ভারতের নর্থ-ঈস্টে নতুন করে ফ্রন্ট খুলেছে যার কারনে মনিপুরকে অশান্ত করে রাখা হয়েছে।এর মধ্যে পাকিস্তানকে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানোর জন্য আমেরিকা অনুমতি দিয়েছে। যার ফলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে পড়ছে। কাশ্মীরের লাদাখে ভারতের সেনা মোতায়েন হয়েছে। আর বাংলাদেশের সীমান্তে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মায়ানমারে যদি ওয়ারফ্রন্ট খুলে যায় তবে ভারতকে তিনটা ওয়ারফ্রন্টে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
আমেরিকার প্ল্যান হচ্ছে ভারতের সেনাবাহিনীকে তিনটি ওয়ারফ্রন্টে বিভক্ত করে রাখা যাতে ভারত দুর্বল হয়ে পড়ে। মিয়ানমারের কালাদান নদীর মোহনায় গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলায় আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত সহায়তা করছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন ও চীন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পন্য ও পরিসেবা পরিবহনের লক্ষ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা। মিয়ানমারের ঘুমধুম হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফের ঝিলিংঝা দিয়ে দোহাজারী পর্যন্ত ট্রানস এশিয়ান রেলওয়ে প্রকল্পতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে ভারতকে দমন ও চীনের নিজ স্বার্থের উন্নয়নে উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগরের এ উপক‚লীয় অঞ্চল চীনের কাছে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিরাট গুরুত্ব বহন করে।
‘জাপান ও রাশিয়ার পর চীন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ঋনদাতা এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশী ঋন দিয়েছে বেইজিং। বিশ্বব্যাংকের কাছে ১৯.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা সহ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋন ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।দেশটি প্রতি বছর চীনের কাছে ২৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সুদ পরিশোধ করেছে (ভোরের কাগজ,০৭-০৮-২৪)।’ কক্সবাজার উপকূলের কুতুবদিয়ার সোনাদিয়াতে নির্মাণাধীন উচ্চ উৎপাদনক্ষম মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জাপান ইতিমধ্যে বিপুল বিনিয়োগ করে বসেছে। এ ছাড়া পাবনার রুপপুরে ১২.৫৬ বিলিয়ন ডলারের পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে রাশিয়া। এ ছাড়া পরাশক্তিরা বাংলাদেশের তেল-গ্যাসের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম