গ্রামই প্রাণ : সোঁদামাটির ঘ্রাণ মেশকআম্বর সমান

4

জসিম উদ্দিন মনছুরি

মাটি ও মানুষের সাথে বন্ধুত্ব আজন্মের। পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে মানুষ সোঁদামাটির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আসছে। কৃত্রিম নগর গড়ে
ওঠার আগে গ্রামই ছিলো পৃথিবীর শিকড়। বাংলার সিগনেচার কবি জসিম উদ্দীন তার নিমন্ত্রণ কবিতায় এক স্নিগ্ধ মায়াময় গ্রামের ছবি এঁকেছেন। ছোট কাজল গাঁয়ে বন্ধুকে ডেকেছেন এক গভীর অনুরাগে-
‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়, / গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়; / তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়’
এমনই গ্রাম জন্মভূমি জননীর। নির্জন নিস্তব্ধ প্রান্তরে নির্মল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। রাতে অন্ধকার ভেদ করে ঝিঁঝি পোকার ডাক মনকে পুলকিত করে। গ্রামের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে অনন্ত যৌবনা বর্ষাকালে। আষাঢ়-শ্রাবণে আকাশের অঝোর কান্নায় প্লাবিত হয় মাঠঘাট ও বিস্তীর্ণ ভূমি। মাছেরা জলখেলিতে দ্রোহী হয়ে বেরিয়ে আসে। জেলেরা মহোল্লাসে তাদেরকে পাকড়াও করে। আষাঢ় মাসে জমিদারের কাচারিতে আষাঢ়ে গল্পের আসর বসে। পৌরাণিক কথার সংলাপে সরগরম হয়ে ওঠে। হুকায় টান মেরে প্রশান্তি খোঁজে অকাজের কাজীরা। এসব আমার আবহমান গ্রাম বাংলার দৃশ্যপট।
শহরের কৃত্রিমতায় মানুষের মন যখন বিষিয়ে ওঠে, ছুটে যেতে ইচ্ছে করে শিকড়ের সন্ধানে গাঁয়ের পথে। গ্রামই যেন সুখের স্বপ্নীল স্বর্গীয় ঠিকানা। গ্রামই হলো আবেগ-ভাবাবেগ আর অনুরাগের আতুরঘর। এই আতুরঘরের খোলনলচে বদলে যাবার প্রাণান্ত চেষ্টা বা রূপান্তর আকাঙ্খা কখনো সফল হতে পারেনি। এ আকাক্সক্ষা আতুরঘরে গুমরে মরেছে। এখনো মানুষের কাছে গ্রামই আত্মা। গ্রামআত্মা থেকে ঝরে যেতে পারেনি কোনো মণি-মুক্তা।
গ্রামই প্রাণ। এখানের সোঁদামাটির ঘ্রাণ মেশকআম্বর সমান। তাইতো গ্রামেই বেহেশতি বাগের ঘ্রাণ নাকে লাগে। গ্রামীণ মানুষ বেহেশতি পরিবেশে। একসময় এমনই পরিবেশের মানুষেরা যখন জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঠাঁই নেয় ইট-পাথরের নগরে, তখন তাদের জীবন ইট-পাথরের নগরে কালো মেঘে ছেয়ে যায়। জীবন হয় একগুয়ে। আদিকাল থেকে গ্রামই ছিলো সহজ সরল মানুষের সুখের ঠিকানা। কালের বিবর্তনে গাঁয়েও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। পরিচিত মানুষগুলো কেমন জানি রূপ বদলে ফেলছে। সাপের খোলস পাল্টানোর মতো নিজেদের রঙ বদল করছে। এখানে বসে আনন্দের মেলা। বৈশাখী মেলা, নবান্ন উৎসব, পুঁথিপাঠের আসর, বলিখেলা, হাডুডু, কানামাছি, মন্দিরা। সুখে-দুখে একজন অপরজনের সমব্যথী হওয়া যেনো গ্রামীণ কালচার। কৃত্রিমতার বিবর্ণ রূপরেখায় গ্রামীণ ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসছে।
মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। ভুলে যাওয়াই তার স্বভাব। জীবন জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। শহরে এসেই অদ্ভুত মানুষগুলো চিরচেনা রূপ পাল্টে ফেলে। হয়ে যায় লেফাফা দুরস্ত। ভুলে যায় নিজের শিকড়। নাগরিক কবি আল মাহমুদের ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় কিভাবে গ্রামের ছেলে শহরে এসে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যায়, তার চমৎকার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বলতে চেয়েছেন, যে বাবা মারফতি গান গেয়ে হাজার শ্রোতাকে মুগ্ধ করতো; তার ছেলে কিনা আজ শহরে এসে সাহেব বনে গিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ভুলে গেছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। অথচ গ্রামের চাষীরাই ফসল ফলিয়ে দেশের তাবৎ জনতার খাদ্য যোগান দিচ্ছে। ফল ফলাদি উৎপন্ন করে মুখরোচক খাবারের যোগান দিচ্ছে। তাদেরকে যেখানে সম্মান দেয়ার কথা, কাঁদামাটির গন্ধ লেগে আছে বলেই সুশীল সমাজ কতই না অবজ্ঞা করছে। যা নিজের অস্তিত্বকে ঘৃণা করার সমতুল্য। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, আমিও একজন গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষ। আমার মনপ্রাণ এখনো গ্রামে পড়ে থাকে। যখন গ্রামে ছুটে যাই, আনন্দের সীমারেখা থাকে না। যেন এখনো পায়ে লেগে আছে কাদামাটির সোঁদাগন্ধ। এই মাটিই আমার প্রাণ। আমার অস্তিত্ব। জন্ম জন্মান্তরের ভালোবাসা। এই গ্রামই আমার স্বর্গ। সুখের অমলিন ঠিকানা। শহরে বসেও কল্পনার জগতে কাদামাটির সোঁদাগন্ধের ঘ্রাণ পাই। যে ঘ্রাণ আমার কাছে গোলাপ-হাসনাহেনার চেয়ে কম সুঘ্রাণের নয়। যে মাটিতে শুয়ে আছে আমার পূর্বপুরুষ বাপ-দাদারা। গাঁয়ের মাটি যেন আমার মায়ের অমূল্য মনিহার। যা টাকা দিয়ে বেচাকেনা হয় না। শতকোটি টাকা দিলেও এই ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। এই ঘ্রাণ শুধু উপলব্ধির, জন্মগত স্বভাবের। চলো সবাই ফিরে যাই শিকড়ের সন্ধানে। স্বর্গীয় সুখের দখিনা শীতল বায়ুর নেশায়। বটের তলায় কবিয়ালের আসরে শীতল পাটির বাসরে। সেখানে থাকবে শুধু গ্রামের সোঁদামাটির মৌ মৌ গন্ধ। যে গন্ধে নেচে উঠবে মৃতপ্রাণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক