‘পাহাড় কাটছি তো, আপনি পারলে লিখে দেন’!

75

মনিরুল ইসলাম মুন্না

‘আমি পাহাড় কাটছি তো, আপনি পারলে লিখে দেন’- এভাবেই দম্ভোক্তি দেখান খুলশীর জালালাবাদ আবাসিকের মিন্টু সাহেবের পাহাড়ের অন্যতম মালিক মো. আলাউদ্দিন। এসময় তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড় কাটা অপরাধ সেটা আমি জানি। আমি সিডিএ’তে ভবন নির্মাণের প্ল্যানের জন্য আবেদন করেছি। ওখান থেকে আমি এখনও প্ল্যান পাইনি। তবে শুক্কুর একটা দোকান নির্মাণের জন্য জায়গা চাইছিলো। তাকে আমি অনুমতি না পাওয়ার কথা জানাই। কিন্তু সে বেশি জোড়াজুড়ি করায় আমি তাকে বলেছি- কাটতে। এখন আপনি যদি পারেন, সেটা লিখে দেন’।
গতকাল শনিবার খুলশী এলাকায় গেলে পাহাড় কাটার এসব দৃশ্য দেখার পর মালিকের সাথে কথা বললে তিনি এসব কথা বলেন। শুধু খুলশীর জালালাবাদ নয়, আকবরশাহ এলাকায়ও নির্বিচারে দিনরাত সমানতালে কাটা হচ্ছে পাহাড়।
দেশের চলমান অস্থিরতা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ এসব পাহাড় কাটছে। এতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন তারা। সবচাইতে বেশি পাহাড় কাটার খবর পাওয়া গেছে নগরের আকবরশাহ এলাকায়। এছাড়াও খুলশীর জালালাবাদ ও বায়েজিদ থানা এলাকায় পাহাড় কাটার খবর পাওয়া গেছে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে, অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সংস্থাটির চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক বেগম সোনিয়া সুলতানা পূর্বদেশকে বলেন, পাহাড় কাটার খবর পেয়ে আমাদের দুইটি টিম আজ (রবিবার) বের হয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরেজমিনে নগরীর খুলশী জালালাবাদ আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জাকির হোসেন সড়ক থেকে জালালাবাদ আবাসিকের সড়কটিতে পাহাড় কাটার মাটি পরিবহনের ট্রাকগুলো চলাচল করায় কাঁদায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে জনচলাচল। সড়কটি দিয়ে এক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে জালালাবাদ আবাসিক এলাকার সাইনবোর্ড। ওই সাইনবোর্ডের বাম পাশে মূল সড়কের পাশেই ১৫ ফিট উচ্চতার একটি পাহাড় রয়েছে। সড়কে যাতে মাটি না আসে, সেজন্য একটি দেয়াল দেয়া হয়। এই পাহাড়টি খননযন্ত্র স্কেভেটর দিয়ে কাটছিল কিছু শ্রমিক।
সেখানে কাজ করা শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওই জায়গার মালিক মো. আলাউদ্দিন নামের একজন। তার এবং শুক্কুরের নির্দেশনায় মো. জয়েন, বাবু এই পাহাড়টি কাটছেন। পাহাড়ের মাটিগুলো জাকির হোসেন সড়কের একটি জায়গায় ফেলা হচ্ছিল।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, ‘পাহাড় কেটে পরিবেশ তো নষ্ট করছেই, সেই সাথে আমাদের চলাচলের পথও ঝুঁকিপূর্ণ করছে। সড়কে পাহাড়ি মাটি পড়ে থাকায় বৃষ্টি হলে তা পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। এতে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আমরা বেশ কয়েকবার তাদেরকে মৌখিকভাবে জানিয়েছি। তারা বিএনপি নেতাদের দাপট দেখাচ্ছেন। মূলত কোনো বিএনপি নেতা এখানে জড়িত নেই। প্রশাসন একটু নিরব থাকায় তারা এর সুযোগ নিচ্ছে’।
অন্যদিকে, নগরের আকবরশাহ থানাধীন ১৩টি স্থানে অন্ততঃ ১৫টি পাহাড় কাটার খবর পাওয়া গেছে। সেখানকার জঙ্গল লতিফপুরের হযরত মির আউলিয়া সড়কের শেষ মাথায় সাগরিকা প্রিন্টিং প্রেসের পেছনে আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে, একই সড়কে মাহফুজের নেতৃত্বে, জঙ্গল লতিফপুর সমাজকল্যাণ কমিটির অফিসের পাশে মো. জামালের নেতৃত্বে, একই এলাকার হাজী ছালেকুর রহমান তালুকদারের বাড়ির পাশে মুরগি ফার্ম এলাকায় মো. জাহাঙ্গীর ও সিদ্দিক সওদাগর এবং তার ছেলে জামালের নেতৃত্বে, মিরপুরের লইট্টাঘোণা এলাকার ১২৮নং দাগের পাহাড়টি নুর উদ্দিনের নেতৃত্বে, মানিক মিস্ত্রির বাড়ির পাশে সেগুন বাগান নোমানের খামার এলাকায় মো. মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে, উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের শাপলা এলাকার গ্যাস লাইন এলাকায় মো. মহিউদ্দিন প্রকাশ লাল মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে, একই এলাকার কোর্ট বিল্ডিং সমিতি এলাকার তোফায়েলের বাড়ির পেছনে মো. খোকনের নেতৃত্বে, উত্তর পাহাড়তলীর হারবাতলী মা আমেনা মসজিদের পেছনে কালাম প্রকাশ পুলিশ কনস্টেবল কালামের নেতৃত্বে, উত্তর লেকসিটি এলাকার এশিয়ান ওমেন ইউনিভার্সিটির পেছনের গেটের সামনে ১৭৮নং দাগে তানিয়া বেগম ও মো. জহির কন্ট্রাক্টরের নেতৃত্বে, মিরপুর লইট্টাঘোণার সেগুন বাগানে মো. কামালের নেতৃত্বে এবং শাপলা এলাকার গ্যাসলাইন মোড়ের পাকা সড়কের শেষ মাথায় নাহিদা আক্তার মুন্নির নেতৃত্বে এসব পাহাড় কাটা হচ্ছে। তারমধ্যে শাপলা এলাকার ১০৫ নম্বর দাগের পাহাড়িতে কালীরছড়া খালটিও অবস্থিত। তার পাশের ৫৪ দাগের বড় পাহাড়টিও কাটার প্রস্তুতি হিসেবে কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ের সব গাছ। এসব পাহাড়খেকোদের মধ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী, মামলার আসামি, চাঁদাবাজ ও চোরা কারবারিরাও। তাদের বিরুদ্ধে সীতাকুÐ, আকবরশাহ, বায়েজিদ থানাসহ পরিবেশ অধিদপ্তরে মামলা রয়েছে।
তবে যাদের নেতৃত্বে পাহাড় কাটা হচ্ছে, তাদেরকে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তাদের কয়েকজনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং বাকি কয়েকজন সরাসরি দেখা করার প্রস্তাব দেন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক বেগম সোনিয়া সুলতানা পূর্বদেশকে আরও বলেন, পাহাড় যে কাটা হচ্ছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখবো। পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।