বন্যায়-জলোচ্ছ্বাসে আমাদের ভ্রাতৃত্ব ও সক্ষমতা

5

মো. দিদারুল আলম

বাংলাদেশের মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং এই ধরনের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে অভ্যস্ত। ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ঘটিত বড় বন্যা আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করেছে। সবসময় আমরা যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে নানা দলে বিভক্ত থাকি, ঝগড়াঝাঁটি করি, দেখা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সেইসব যেন সবাই ভুলে যায়। এবারের বন্যায়ও তাই হয়েছে। ভারতে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় তারা তাদের বাঁধ খুলে দেওয়া ও দেশে অতি বৃষ্টিতে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এখন পর্যন্ত বন্যায় ৫৪ জন মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৪১ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও ৭ শিশু। বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২। বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ফেনীতে ১৯ জন এবং আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টি। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পানিবন্দী রয়েছেন ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২ পরিবার। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) দুপুর ১টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুর্যোগের আকস্মিক ঝুঁকি কমাতে এবং সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কার্যকর নীতি ও অনুশীলন প্রয়োজন। দুর্যোগের এ পরিবর্তিত প্রকৃতি এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার তার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়; কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে তা মোকাবেলা করা সম্ভব। সরকারেরর গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনার কারণে বর্তমানে বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে রোল মডেল হিসাবে পরিচিত হয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচাইতে বড় টনিক হিসেবে কাজ করেছে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক ভালোবাসা।
সুদূর অতীতে বাংলাদেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সক্ষমতার কারণে বর্তমানে এ সংখ্যা অনেক কম এবং ক্ষতির পরিমাণও অনেকাংশে কমেছে। সাম্প্রতিককালে সংঘটিত অনেক সুপার সাইক্লোনের সময় ১৮ থেকে ২৪ লাখ মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছে। এসব সাইক্লোন ও বন্যায় প্রাণহানির সংখ্যা খুব কম। দুর্যোগের আগাম প্রস্তুতি হিসাবে সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। উপক‚লীয় এলাকায় রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষ স্বেচ্ছাসেব প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখন যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করতে আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা যেমন, উইন্ডি, আইএমডি, জিএফএস ইত্যাদি এর আবহাওয়ার পূর্বাভাসও গ্রহণ করা হয়। ফলে অনেক যাচাই-বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ হলো-পর্যাপ্ত সম্পদ এবং তহবিলের অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, অপর্যাপ্ত তথ্য এবং তথ্যের অব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি। এসওডি-২০১৯ ও এনপিডিএম ২০২১-২০২৫ কার্যকরভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের অবশ্যই দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।
উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ ও পুনর্বাসন করে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন সম্পর্কিত বিষয়বস্তু পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিভিন্ন দুর্যোগে জন্য প্রয়োজনীয় স্থানীয় মানুষ এবং স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। সর্বোপরি, জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিম্ন-আয়ের পরিবারকে ধীরে ধীরে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে যে জেলাগুলোতে বন্য হয়েছে, তাদের অনেকের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যা যতই ত্রাণ দেওয়া ও বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হোক না কেন তা কখনো পূরণ হয়ে উঠবে না। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে পরিচিত উপকূলীয় অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনের সংরক্ষণ ও পুনরায় বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম জোরদার করা খুবই জরুরি পাশাপাশি দেশব্যাপী ব্যাপক গাছ রোপন করতে হবে এবং এ কাজটি খুব দ্রæততার সাথে করা উচিত।
স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে বন্যা আক্রান্ত জায়গাগুলোতে। এছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাণ সংগ্রহ করে আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরা। জলে নিমগ্ন দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে নৌকা, স্পিডবোট ইত্যাদি নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষ। ত্রাণ সংগ্রহে ঢাকার টিএসসিসহ দেশের সব জেলায় সব শ্রেণির মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। যা বিশ্বে বিরল। যে যেই মতবাদের হোক না কেন বন্যা বা যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে সবাই এক সাথে হয়ে কাজ করে। তা না হলে আমাদের দেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভবপর হয়ে উঠতো না। যেভাবে দল-মত নির্বিশেষে বন্যার্ত মানুষকে রক্ষ করার জন্য এগিয়ে এসেছে তা এক কথায় অতুলনীয়। আশা করি ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনায় সবাই এগিয়ে আসবে। যেহেতু আমাদের দেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ, তাই বাছাইকৃত প্রত্যেক জেলার উদ্যমী কিছু যুবকদের উদ্ধার কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক