বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা সিএমপির থানাগুলোতে

3

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাস চলাকালে নগর পুলিশের আটটি থানা সরাসরি হামলা-আগুন ও লুটতরাজের শিকার হয়। খোয়া যায় অস্ত্র ও গেলাবারুদ। পুড়ে ছাই হয়ে যায় মামলা-মোকদ্দমার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। সর্বমোট ১৬ থানার মধ্যে আটটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। প্রাণরক্ষায় থানা ছেড়ে যান পুলিশ সদস্যরা। কর্মবিরতি শেষে পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে থানাগুলোতে।
জানা গেছে, পুলিশ সদস্যরা দায়িত্বে ফিরলেও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ানো থানাগুলোতে এখনও নিয়মিত কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জিডি বা মামলা রেকর্ডের মত দাপ্তরিক কার্যক্রম ছাড়া থানার বাইরে পেট্রল ডিউটি ও অভিযান পরিচালনা একপ্রকার বন্ধই রয়েছে। স্থবির হয়ে রয়েছে বিভিন্ন মামলার তদন্ত কার্যক্রম। সংকট সামলে নিয়ে থানাগুলো পূর্ণোদ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যেতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
এমন বাস্তবতায় সম্প্রতি সিএমপিসহ দেশের থানাগুলোতে নতুন নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত এই পরিপত্রে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত বিভিন্ন অভিযোগ ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জননিরাপত্তা বিভাগ অবহিত হয়েছে যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু কিছু থানায় জিডি-এফআইআর-মামলা গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন-বিলম্ব করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দ্রুত প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করা যাবে না। পরিপত্রে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে জনসাধারণের বিভিন্ন অভিযোগ দ্রুত তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সিএমপি সূত্র জানায়, ঘটনার দিন গত ৫ আগস্ট থানার পাশাপাশি হামলার ঘটনা ঘটেছিল পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক বক্সসহ পুলিশের ২৯টি স্থাপনায়। একইসঙ্গে থানা কম্পাউন্ডে থাকা বিভিন্ন ধরনের ৪৫টি যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনারপর থেকে অদ্যাবধি ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে থানাগুলো। আসবাবপত্রসহ সংকটের পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংকট। ইতোমধ্যে থানাগুলোর কার্যক্রম শুরু হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আক্রমণ চলাকালে বিভিন্ন থানা থেকে পাঁচশ’টি অস্ত্র এবং ১২ হাজারের মতো গোলাবারুদ লুট হয়। এখনও উদ্ধার হয়নি দুইশ’ ২০টির মতো অস্ত্র। অস্ত্র-গুলি এবং যানবাহন ছাড়াও থানা ভবনের অবকাঠামো পুড়ে অন্তত ২১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাসের সময় কতিপয় বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের স্থাপনায় হামলা চালানোর পাশাপাশি আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় থানা, পুলিশ ফাঁড়ি এবং পুলিশ বক্সসহ ২৯টি স্থাপনা। স্থাপনাগুলোর মধ্যে আছে কোতোয়ালি থানা, পাহাড়তলী থানা, পতেঙ্গা মডেল থানা, ইপিজেড থানা, চান্দগাঁও থানা, ডবলমুরিং থানা, হালিশহর থানা, আকবর শাহ থানা ও সদরঘাট থানা। পাশাপাশি মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ি, বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স, মোহরা পুলিশ বক্স, বায়েজিদ বোস্তামী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়, সদরঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, পাথরঘাটা পুলিশ ফাঁড়ি, টাইগারপাস পুলিশ বক্স, দামপাড়া ওয়াসা মোড় ট্রাফিক পুলিশ বক্স, সিটি গেট চেকপোস্ট, দামপাড়া পুলিশ লাইন, নিউমার্কেট মোড় ট্রাফিক পুলিশ বক্স, খুলশী ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। লুট হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। হামলায় পুলিশের ডাবল কেবিন পিকআপ, সিঙ্গেল কেবিন পিকআপসহ ২৯টি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ৩৫টি গাড়ি। লুট করে নিয়ে গেছে ১২টি মোটরসাইকেল। পুলিশ জানিয়েছে, অবকাঠামোর মধ্যে পাহাড়তলী থানায় ক্ষতি এক কোটি ৬০ লাখ, ইপিজেড থানার ক্ষতি ৭০ লাখ, পতেঙ্গা থানার ৮০ লাখ, হালিশহর থানার এক কোটি ৫০ লাখ, ডবলমুরিং থানার এক কোটি ২০ লাখ, চান্দগাঁও থানার এক কোটি ২০ লাখ, বন্দর থানার এক কোটি ৫০ লাখ, সদরঘাট থানার ৮০ লাখ এবং আকবরশাহ থানার ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফাঁড়িগুলোর মধ্যে পাথরঘাটা ফাঁড়ির ৮০ লাখ, সদরঘাট ফাঁড়ির এক কোটি, ইপিজেড ফাঁড়ির ৭০ লাখ, উত্তর হালিশহর ফাঁড়ির ৬০ লাখ এবং মোহরা ফাঁড়ির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০ লাখ টাকা।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, সিএমপির থানা এবং পুলিশ ফাঁড়িগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। আসবাবপত্র ও যানবাহনসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলমান আছে। থানাগুলো ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি পাঁচশ’টি অস্ত্র ও ১২ হাজারের বেশি গুলি লুট হয়। এখনও উদ্ধার হয়নি দুইশ’ ২০টি অস্ত্র। এর মধ্যে র‌্যাবের অভিযানে থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া ৩৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র এবং দুইশ’ ৯৭ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করে সিএমপিতে জমা দেওয়া হয়েছে।
সিএমপির পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কাজী মোহাম্মদ তারেক আজিজ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত সময়সীমা মেনে সিএমপিতে সব পুলিশ সদস্য এরইমধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। সিএমপির সব থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে। সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাও স্বাভাবিক হয়েছে। সিএমপিতে বর্তমানে পুলিশের ছয় হাজার একশ’ ৬৯ পুলিশ সদস্য কর্মরত রয়েছেন। তবে অবকাঠমো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হামলার শিকার হওয়া থানাগুলো স্বাভাবিক করতে সময় লাগবে।