পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে

4

শহীদুল ইসলাম বাবর, সাতকানিয়া

চট্টগ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। প্রতি বছরই এই ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হলেও এ হার কমিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ নেই, নেই কোনো পদক্ষেপও। গত চার মাস ১০ দিনে শুধু চট্টগ্রাম জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে ২৫ শিশু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকরা সচেতন না হলে এই হার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।
জানা যায়, গত ১৩ আগস্ট আনোয়ারার হাইলধর ইউনিয়নের হেটিখাইন গ্রামে বাড়ির পাশে পুকুরে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যু হয়। তারা হচ্ছে প্রবাসী হাসান আলীর মেয়ে তানিশা (৮) ও মোরশেদ হোসেনের মেয়ে রুহি (৫)। তারা সম্পর্কে আপন চাচাত বোন। এর আগে ১২ আগস্ট ফটিকছড়ির দাঁতমারায় পানিতে ডুবে সাজ্জাদ (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। শিশু সাজ্জাদ ইউপির ৩নং ওয়ার্ডের নিশ্চিন্তার আঁধারিয়া গ্রামের প্রবাসী আব্দুল মান্নানের ছেলে। সে স্থানীয় নুরানি মাদ্রাসার ১ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
তারও আগে গত ৯ জুলাই বাঁশখালীতে পুকুরে ডুবে আবির নামের ১৮ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়। উপজেলার ৭নং সরল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আবির ওই এলাকার হেলালের ছেলে। ১৪ জুলাই লোহাগাড়ায় পুকুরের পানিতে ডুবে রাজশ্রী সুশীল নামে ২ বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়। দুপুর ২ টার দিকে উপজেলার আধুনগর শীল পাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। রাজশ্রী সুশীল ওই গ্রামের পলাশ সুশীলের মেয়ে।
১৩ জুলাই রাঙ্গুনিয়ায় খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে রুহি আকতার (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। নিহত শিশু উপজেলার চন্দ্রঘোনা-কদমতলি ইউনিয়নের লিচুবাগান এলাকার মো. মঞ্জুর ছেলে। ১৬ জুন দুপুরে সীতাকুন্ড উপজেলার কুমিরা ঘাটে গঙ্গা স্নানে গিয়ে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। তারা হলো খুশী রানী জলদাস ও কিশোরী বালা জলদাস। আনুমানিক ১০ বছর বয়সী এ দুই শিশু কুমিরার দক্ষিণ জলদাস পাড়ার বাসিন্দা।
এছাড়াও ১৪ জুন চন্দনাইশের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের যতরকুল কাজী বাড়ির ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মুছা পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামের বাড়ি যতরকুলে আসেন কোরবানির ঈদ পালন করতে। এদিন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর তার মেয়ে ওয়াজিহা (৬) বাড়ির উঠানে খেলার কোনো এক এসময় সবার অজান্তে পুকুরে পড়ে ডুবে মারা যায়। ৩ জুন বাঁশখালীতে পুকুরে মাছ ধরতে নেমে পানিতে ডুবে মারা যায় শেখেরখিল উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তামজিদ হোসেন (১১)।
অন্যদিকে গত ৩১ মে সাতকানিয়ার ছদাহা ইউনিয়নে তোহা মিয়া নামে ১৪ বছরের এক শিশু পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। ২৬ মে সকালে আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়া ইউনিয়নের সিকদারের বাড়ির পুকুরের পানিতে ডুবে মো. ইমন (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২৪ মে হাটহাজারী উপজেলায় পৃথক স্থানে পুকুরের পানিতে ডুবে মো. নওশাদ (১১) ও তাজবীদ (২) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। একই দিন রাঙ্গুনিয়ায় পুকুরে ডুবে মারা যায় মো. আয়ান (৪) নামের এক শিশু। ২২ মে বাঁশখালীর পৃথক স্থানে পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া শিশুরা হলো উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আল মামুন ফয়সালের মেয়ে রোমাইসা জান্নাত (২) ও বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নেয়াজর পাড়া এলাকার আবু হামিদের ছেলে মেহাম্মদ আবির (২)। ১৮ মে রাঙ্গুনিয়ায় পুকুরে ডুবে মুহাম্মদ শাওন (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। শাওন ইসলামপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাহেবনগর এলাকার শাহ ছুফি আব্দুল কাদের (রহ.) দাখিল মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
তারও আগে ২৮ এপ্রিল আনোয়ারায় পুকুরের পানিতে ডুবে মোহাম্মদ রায়হান (৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২২ এপ্রিল চন্দনাইশে পুকুরে ডুবে নুসরাত জাহান ফারিয়া মিম্পা (৭) ও জান্নাতুল মাওয়া (৯) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। ১৪ এপ্রিল ইপিজেড এলাকায় পানিতে ডুবে মো. সামিদুল নামের ৯ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। ৫ এপ্রিল বাঁশখালীর শীলক‚প ও সরল ইউনিয়নে পুকুরের পানিতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু হয়। তারা হলো- শীলকূপ ইউনিয়নের মাইজপাড়ার আবু ছালেকের মেয়ে ওয়াজিফা বেগম (৬), রিয়াজ উদ্দিনের মেয়ে মারিয়া আক্তার (৫) এবং সরল ইউনিয়নের মিনজিরিতালা গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে তাহরিন বেগম (৬)।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করা চট্টগ্রামের আইনজীবী বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এএম জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেশি হলেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে প্রথমত প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি প্রয়োজন। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। ওই সময়ে মায়েরা কাজে ব্যস্ত থাকেন। তখন তারা শিশুদের তদারকিতে না থাকার কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে বেশি। তাই শিশুদের নজরদারিতে রাখতেই হবে।
এএম জিয়া হাবিব আহসান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিশু বয়স থেকেই সাঁতার শেখানো হলেও বাংলাদেশে এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিকভাবে নেওয়া হয় না। ফলে সাঁতার না জানার কারণেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। নানার বাড়ি, খালার বাড়ি, ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কিংবা কোনো উৎসবে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এ ক্ষেত্রে কোথাও বেড়াতে গেলে নিজ সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে। তাহলেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আসতে পারে বলেও জানান তিনি।