প্যারিস অলিম্পিকসের বর্ণিল উদ্বোধন

9

পূর্বদেশ ডেস্ক

প্রথমবারের মতো স্টেডিয়ামের বাইরে আয়োজন। তাও আবার নদীতে! প্যারিস অলিম্পিকসের একেবারেই ভিন্ন স্বাদের এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাক্ষী হলো বিশ্ব। সেন নদীতে ভেতরে, পাড়ে সাজানো মঞ্চ, লেডি গাগার গান, ফরাসি সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা, নৌযানে দলগুলোর মার্চ পাস্ট, মশাল নিয়ে মুখোশ পরা রহস্যময় একজনের ছুটে চলা, বিশ্ববিখ্যাত মোনালিসা চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যাওয়া, ‘মিনিয়নস’-এর তা খুঁজে পাওয়া থেকে শুরু করে অন্যরকম এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপহার দিল ‘সিটি অব লাভ’ খ্যাত প্যারিস। খবর বিডিনিউজের
১৯ দিনের আসরে এবার লড়াই হবে ৩১৯টি সোনার। যদিও দুই দিন আগেই সে লড়াই শুরু হয়ে গেছে আর্চার, ফুটবল, রাগবির মতো কিছু ইভেন্টের মধ্য দিয়ে। তবে শুক্রবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো লাখো ক্রীড়াপ্রেমী ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে। সেন নদীর দুই পাড়ের সংযোগ সেতুতে ওড়ানো হলো তিন রংয়ে ধোয়া। ১০১ অ্যাথলেট নিয়ে গ্রিস দলের অ্যাথলেটদের নৌকায় করে আসা দিয়ে মার্চ পাস্টের শুরু। একে একে আসতে থাকে দলগুলো। বড় নৌযানগুলোয় একই সাথে একাধিক দলের অ্যাথলেটরা সওয়ার হন।
৮৫টি নৌকায় আসেন সব দেশের অ্যাথলেটরা। নৌযানগুলো যাওয়ার সময় পাশেই পানির ফোয়ারাগুলো একসঙ্গে সক্রিয় হলে অন্যরকম কুয়াশাচ্ছন্ন আবহ তৈরি হয়। হালকা বৃষ্টি প্যারিস অলিম্পিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এনে দেয় জাদুকরী মাদকতাও।
এরই মধ্যে লেডি গাগা নদী তীরে সাজানো মঞ্চে গাইতে আসেন দল নিয়ে। একটু পরই দেখা যায় বাংলাদেশ দলকে বহনকারী নৌকা। লাল-সবুজের পতাকা এবার বহন করছেন সরাসরি প্যারিস অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আর্চার মোহাম্মদ সাগর ইসলাম। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ জন অ্যাথলেট অংশ নিচ্ছে প্যারিস অলিম্পিকসে। ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ পাওয়া দুই সাঁতারু সামিউল ইসলাম রাফি, সোনিয়া খাতুনের সঙ্গে আছেন শুটার রবিউল ইসলাম ও স্প্রিন্টার ইমরানুর রহমান।
নদীর পাড়ে সমর্থকদের সরব উপস্থিতি, তীরবর্তী বাড়িগুলোর ব্যালকনিতে, জানালায় দাঁড়িয়ে ক্রীড়াপ্রেমীরা উপভোগ করেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সংযোগ সেতুর উপর তৈরি করা হয় গ্যালারি, সেখানেও ছিলেন দর্শকরা। হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে রাখেন তারা অনুষ্ঠান।
নদীর পাড়ে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, নাচের দল নৃত্য পরিবেশন করছে, কেউ নানা শারীরিক কসরত দেখাচ্ছে, কুচতাওয়াজও চলছে। নদীর মধ্যেই বড় বড় বোর্ডে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা মানুষের মুখচ্ছবি। এরই মধ্যে রহস্য বাড়ায় মুখোশ পরে মশাল নিয়ে ছোটা একজনের উপস্থিতি।
প্যারিস অলিম্পিকসের পদকগুলো তৈরির প্রক্রিয়াও দেখানো হয়। পদকে থাকছে ফ্রান্সের ঐতিহ্য আইফেল টাওয়ারের ছাপ। এরপরই মাস্ক পরা ওই ব্যক্তি একটি বক্সে রাখেন মশালটি। সেটি বয়ে আনেন বাকিরা।
পাড় ও পার্শবর্তী বাড়িতে ব্যালকনির অংশে সাজানো মঞ্চে শুরু হয় সঙ্গীত। হেভি মেটালের সঙ্গে বেজে ওঠে লা মিজারেবল সিনেমার ‘ডু ইউ হেয়ার দ্য পিপল সিং’ গানটি। ফরাসি বিপ্লবের ছবি ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা।
একটু পর ফের মশাল হাতে উদয় হন মুখোশ পরা সেই মানুষটি। সেতুর উপর রাখা টর্চ পেপারে মশালটি তিনি ছোঁয়াতেই আতশবাজির ফোয়ারা ছোট দুই পাশে। সেতুর অপর প্রান্তে সাজানো মঞ্চে আবির্ভাব হয় মালিয়ান বংশোদ্ভূত ফরাসি গায়িকা আয়া নাকামুরার, তিনি গেয়ে ওঠেন ইকুয়ালিটি গানটি।
কিছুক্ষণ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনের পর দৃশ্যপটে আবার হাজির মুখোশ পরা নাম না জানা সেই রহস্যময় মানুষটি। ১৯১১ সালে চুরি হয়ে যাওয়া মোনালিসার ছবির ভাঙা ফ্রেমের সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। এরপর মিনিয়নসদের তা খুঁজে পাওয়ার দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয় পর্দায়। ভিন্নধর্মী এই আয়োজনে উল্লাসে ফেটে পড়েন দর্শকরা।
উস্তালিজ সেতু থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, নথু-দেম ক্যাথেড্রালের পাশ ঘেঁষে অনেক সেতু পাড়ি দিয়ে অবশেষে সবাই ছুটতে থাকেন আইফেল টাওয়ারের দিকে। সেতুর উপর সাজানো মঞ্চে চলতে থাকে ফ্যাশন শো, গান। মার্চ পাস্টের একেবারে শেষে আসে স্বাগতিক ফ্রান্সের অ্যাথলেটদের বহনকারী ইয়াট।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর পাড়ে জ্বলে থাকা আলোতে অন্যরকম আবহ চারদিকে। সংযোগ সেতুতে সাজানো লাইটিং ছড়াতে থাকে মুগ্ধতা। ফরাসি সমর্থকদের বাঁধনহারা উচ্ছ¡াসের ফোয়ারা বইতে থাকে।
বর্ণিল সন্ধ্যার মুগ্ধতা ভিন্ন মাত্রা পায় নদীর মধ্যে সাজানো ভাসমান মঞ্চে জন লেননের ‘ইমাজিন’ গানের মূর্ছনায়। বৈশ্বিক সাম্যের যে গান আর অলিম্পিকসের বার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পিয়ানোর সুরে।
অলিম্পিকের পতাকা পিঠে মুড়িয়ে ‘কৃত্রিম’ ঘোড়ায় চেপে ছুটতে থাকতে দেখা যায় এক অশ্বারোহীকে, তার হাতে অবশ্য ছিল না মশাল। পুরানো দিনের অলিম্পিকের সংবাদ, নানা মুহূর্তের তথ্যচিত্র ভেসে ওঠে পর্দায়। অশ্বারোহী ছুটতে থাকেন। সবগুলো দেশের পতাকা নিয়ে আইফেল টাওয়ারের নিচে সমবেত হতে থাকেন প্রতিনিধিরা। এরপর সত্যিকারের ঘোড়ায় চেপে টাওয়ারের নিচ দিয়ে আগমন সেই অশ্বারোহীর। অলিম্পিকের পতাকা তিনি বয়ে নিয়ে তুলে দেন কর্মকর্তাদের হাতে। পতাকা ওড়ানোর সময় বেজে ওঠে অলিম্পিকের সঙ্গীত।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মূল মশাল প্রজ্জ্বলনের। কিন্তু কে জ্বালাবেন? এখানে রহস্য রেখেছিল আয়োজকরা, যেমনটা ছিল লেডি গাগার উপস্থিতি নিয়েও।
আয়োজক কমিটির সভাপতি, তিনবারের ক্যানন স্লেলুমের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন টনি এস্টাঙ্গুয়ে অ্যাথলেটদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এটা ভালোবাসার শহর। এবং আগামী ১৬টি দিন, এই শহর আপনাদের’। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি টমাস বাখ তার বার্তায় তুলে ধরেন অলিম্পিকসের উদ্দেশ্য, ‘এই আয়োজন বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করে’।
এরপর মঞ্চে আসেন বিশ্বকাপ জয়ী কিংবদন্তি ফুটবলার জিনেদিন জিদান। মুখোশ পরা সেই রহস্যময় মানবের মঞ্চে আগমণ মশাল হাতে; তুলে দেন জিদানকে। ‘জিজুর’ হাত থেকে মশাল যায় ফ্রেঞ্চ ওপেনের রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়ন ও রোঁলা গাঁরোর ‘সম্রাট’ স্প্যানিশ তারকা রাফায়েল নাদালের হাতে। আইফেল টাওয়ার দিয়ে ছুটতে থাকে আলোর রোশনাই।
আরেক টেনিস কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামসের হাতে মশাল তুলে দিয়ে তার সঙ্গে স্পিডবোটে চেপে বসেন নাদাল। সেখানে তাদের সঙ্গী হন দুই গ্রেট অ্যাথলেট কার্ল লুইস ও জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমিনেচি। চার কিংবদন্তি মিলে মশাল নিয়ে পরিভ্রমণের পর নোঙর ফেলেন এক পাড়ে। সেখানে নিজের হাতে থাকা মশাল জ্বালিয়ে ছুটতে থাকেন ফরাসি সাবেক টেনিস তারকা এমিলি মরিসমো। টনি পারকারের পর আরও কয়েক হাত ঘুরে মশাল যায় জুডোকা টেডি রাইনার ও স্প্রিন্টার মারিয়ে-জোসে পিয়ার্সের হাতে। ল্যুভর, প্যালেস দে লা কনকর্ডের লাগোয়া বেলুনে আগুন দেন দু’জনে। আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা ওঠে প্যারিস অলিম্পিকসের।
সকালে রেলের নেটওয়ার্কে হামলায় যে শঙ্কা উঁকি দিয়েছিল, সন্ধ্যোয় তা উড়ে যায় ভিন্নধর্মী, মন জুড়ানো জমকালো উদ্বোধনীতে।