মাঠে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার মূলে বিরোধ

16

রাহুল দাশ নয়ন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে দলীয় অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে দলীয় নেতাকর্মীদের নিস্ক্রিয়তা দলটির হাইকমান্ডকে ভাবাচ্ছে। নতুন সরকার গঠনের পর দল যেখানে উজ্জীবিত হওয়ার কথা সেখানে এমন ব্যর্থতা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে ঢাকার নেতাদের নিয়ে সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে উঠে আসে, দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রধান কারণ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভাতেও নেতারা একে অপরকে দুষছেন, একে অপরের দিকে তেড়ে গেছেন।
সংগঠনের এমন দুরাবস্থা শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রামের অবস্থাও শোচনীয়। প্রতিটি সভা-সমাবেশে নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে বলতে কুন্ঠাবোধ করছেন না। আর এমন বিরোধের নেপথ্যে রয়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিরোধ। এই দুই নির্বাচনী বিরোধের প্রভাব পড়েছে রাজনীতির মাঠে। যা কোটা সংস্কার আন্দোলনে দৃশ্যমান হয়েছে।
চট্টগ্রামে জাতীয় নির্বাচনে ১৬টি আসনে ৩০ জন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৩টি উপজেলায় ৪২ জন আওয়ামী লীগের নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এক কথায়, গেল আট মাস ধরে এই দুই নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দুই নির্বাচনে প্রার্থীদের হয়ে নির্বাচনী মাঠে কাজ করতে গিয়ে নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। নির্বাচনী বিভক্তি মিমাংসায় কেন্দ্র থেকে বারবার বলা হলেও তা মাঠপর্যায়ে ঠেকেনি। এমনকি নির্বাচন করা নেতাদেরকেও দলের দুঃসময়ে কর্মীদের পাশে কিংবা মাঠে থাকতে দেখা যায়নি।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের উপর ভর করে দেশজুড়ে নাশকতা চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। আন্দোলনকে পুঁজি করে চট্টগ্রাম শহরে নাশকতা চালালেও গ্রামাঞ্চলে বড়ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি। বিশেষ করে অতীতে যেসব উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল সেখানের পরিবেশ ছিল এবার শান্ত। কোন কারণে এবারের আন্দোলনের প্রভাব যদি গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তো তাহলে আওয়ামী লীগের দুর্দশার চিত্র আরও ফুটে ওঠতো। যেটি চট্টগ্রাম শহরে দেখা গেছে। বিশেষ করে যেসব এলাকা জামায়াত-বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত সেখানে দলের মধ্যে এখনো শৃঙ্খলা ফিরেনি। নির্বাচনকালীন সময়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল তা দ্রুত নিরসন না করার খেসারত দিতে হচ্ছে দলকে। এখনো অনেক এলাকায় কমিটি গঠন হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে সংগঠন চলছে। একশ্রেণির নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। বাকিরা শুধু রাজনীতি করেই যাচ্ছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হিমশিম খাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি পূর্বদেশকে বলেন, কেন্দ্র থেকে আমাদের তেমন কোন অফিসিয়ালি নির্দেশনা দেয়া হয়নি। বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। কেন্দ্র যদি সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়ে জানতে চায় তাহলে আমরা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দাখিল করবো।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল দুইজন নেতা বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল যৌক্তিক। এমন আন্দোলন প্রতিহত করতে পূর্ণশক্তি নিয়ে মাঠে নামলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উত্তেজনা আরও বেশি বাড়তো। দল থেকেও সাংগঠনিকভাবে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়নি। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার স্বার্থে নেতাদের মাঠে না থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এরপরেও শুধুমাত্র ছাত্রলীগই মাঠে নেমেছিল। পরবর্তীতে তাদেরকেও থামিয়ে দেয়া হয়। যখনই আন্দোলন বিএনপি-জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখন দেশে শান্তি ফেরাতে কারফিউ জারি হয়। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার প্রয়োজন পড়েনি।
চট্টগ্রাম কোটা সংস্কার আন্দোলন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জিইসি মোড় থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত এলাকা, লালদিঘি পাড়, কাজির দেউড়ি, আন্দরকিল্লা,জামালখানেই বেশি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে মূল আন্দোলন হয়েছিল জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট এলাকায়। সেখানে বেশ কয়েক দফা আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছে। মহানগর ছাত্রলীগের মতো সংগঠন পূর্ণশক্তি নিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করতে মাঠে নামেনি। এমনকি নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর নিজেও যুবলীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চুর নেতৃত্বে আন্দোলন প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন নেতাকর্মীরা। এমনকি জীবনঝুঁকিতে পড়েছে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন পূর্বদেশকে বলেন, ‘দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে আমরা এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করি নাই। আমরা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর অবশ্যই সবগুলো বিষয় নিয়ে বসবো। শুনছি, কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।’