বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো !

11

বহু প্রতীক্ষার পর এবারের বর্ষায় সারা দেশে বৃষ্টি নামলো। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর সাথে এবার ভেসে এলো প্রচুর জলভরা মেঘমালা। কিছু দিন আগেও দেশে বয়ে গেছে প্রচন্ড তাপ প্রবাহ। অতীষ্ঠ দেশবাসী বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকা নামাজ আদায় করার সংবাদ এসেছিল গণমাধ্যমে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ ব্যাঙের বিয়েরও আয়োজন করে। যাই হোক আল্লাহর অশেষ রহমতে এবারের বর্ষা মৌসুমে ভালো বৃষ্টিপাত দিয়েছেন। অবশ্য উজানের ভারত, সিকিম, ভুটানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটসহ উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। তারপরও দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল। এটা চির সত্য যে, বিশ্ব মানব সমাজ প্রতিনিয়তই বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। তাই তো বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বৃষ্টির ভূমিকা প্রজ্জ্বোল। আবার বৃষ্টি নিন্দিতও বটে। বৃষ্টির প্রতি মানুষের এই অন্তহীন আকর্ষণ সম্ভবত পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। শুধু মানব সমাজ নয় উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সকলেই বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। কীটপতঙ্গ, তরুলতা, পশুপাখি এবং মানুষের মাঝে বৃষ্টিপ্রীতি লক্ষণীয়। বৃষ্টিতে প্রকৃতি ও প্রাণীজগত প্রজননেও সৃজনে নবজীবন লাভ করে। তেমনি ভূমিও সতেজ ও সুফলা হয়ে উঠে। তবে বৃষ্টিপাত যেমন দৃশ্যপট শান্তিপূর্ণ হয় তেমনি বিভীষিকার কারণও বটে। বৃষ্টিপাত সুখানুভূতি দিতে পারে। জগতে পারে বিরহ বেদনা, দুঃখবোধ। মেঘদূতের কবিরা বৃষ্টিতে বিরহকাতর ছিলেন। লংরেইন নামক ইংরেজী বিখ্যাত গল্পে বৃষ্টির পূর্ণ চরিত্রের রূপ ধরা আছে। গল্পে অবিরাম বর্ষণ, কুয়াশা বন্যা। যা চাবুকের মতো আঘাতের পর আঘাত করেছে। অবিরাম বৃষ্টি ঝিঁর মতো কানে তালা লাগিয়ে দেয়। আমাদের আধুনিক নগর ও গ্রামগুলোতে ইটপাথরের জঞ্জালে বৃষ্টির সেই বোধ নেই।
বিজ্ঞানিরা বলছেন সমগ্র সৌরজগতে পৃথিবীই একমাত্র পানিপূর্ণ গ্রহ নয়। পৃথিবী ছাড়াও মঙ্গল ও শুক্রে সৃষ্টির সূচনাতে পানির অস্থিত্ব ছিল। আমাদের পৃথিবী হলো সেই কারণে ব্যতিক্রমি গ্রহ, যে কিনা পানিকে ধারণ করতে পেরেছে। একমাত্র পৃথিবীই জীবনের উৎস হিসাবে পানিকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীবাসীর সৌভাগ্য এই যে, দিগন্ত রেখায় মেঘের আনাগোনা দেখতে পায়। যাতে থাকে জলভরা মেঘ। বৃষ্টির পূর্বাভাস। অথচ মানব জাতি এই দিগন্ত রেখাকে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর করে তুলছে। জীবাষ্ম জ্বালানীও বৃক্ষনিধন তার অন্যথম কারণ। হায় মানুষেরা ভুলে যাচ্ছো পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে প্রথম বৃষ্টিই জীবনের উম্মেষ করেছিলো। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের মতে ‘উষ্ণখুদে জলাশয়ে’ আদীম কোষরাজি হিসাবে জীবন বিকশিত হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেকেই মনে করেন, গভীর সাগরতলের উষ্ণ প্র¯্রবনে আদিম জীবনের যাত্রা শুরু। তাই বলা হয় জীবনের বিকাশের প্রথম পর্বে বৃষ্টিপাতের ভূমিকা ছিল। পানিকে জীবন শক্তি হতে হলে তাতে থাকতে হবে একটি নীল আকাশ। যেখানে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে মেঘের দল। যার মাধ্যমে বৃষ্টি হয়ে ভূ-পৃষ্ঠে নেমে আসতে পারে। পানির ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এই কাজটি চক্রাকারে বারবার বলতে থাকতেই হবে। চার বিলিয়ন বছর আগে সেই প্রথম বৃষ্টিপাতের পর আজও প্রতিদিনের বৃষ্টির আমল ধারা ভূপৃষ্ঠ, নদী, নালা, সাগর, মহাসাগরকে ভরিয়ে তোলে।
প্রাণ টিকে থাকার জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য। শুধুই কী তাই ? আমাদের মন হৃদয় জুড়ে রয়েছে বৃষ্টির অমেয় সুরধ্বনি ও ছন্দ। ফসল ফলানোর জন্যও চাই বৃষ্টি। রবি ঠাকুরের কবিতার শুধু ‘জলপড়ে পাতা নড়ে’ পংক্তিমালা দিয়ে। বৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে সৌন্দর্য এবং বিষ্ময়ের এক অপূর্ব অনুভূতির রূপ দেয়। অতএব বৃষ্টি শুধু পানির উৎসই নয় জীবনের ছন্দ ও সৌন্দর্যবোধের উৎস উপমহাদেশের প্রাচীন সাহিত্যে বর্ষাকে বিরহের আবহে বিহ্নিত করা হয়েছে। বৃষ্টির ঋতু বর্ষাকে বিরহের আবহে প্রথম শব্দচিত্রে তুলে ধরেছিলেন সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাস তাঁর কবিতায়। কালিদাস মেঘদূত কাব্যগ্রন্থে বক্ষের বিরহ বার্তা, যক্ষ প্রিয়ার বেদনা, আর্তি ও কুবেরের অভিশাপ আর মেঘের দৈত্য অভিযানকে কাব্যরূপে প্রস্ফূটিত করেন। বাংলা ভাষার কবি না হয়েও কালিদাস বাঙালি পাঠকের হৃদয় জয় করেছিলেন। বাংলা ভাষায় মেঘদূত অনুদিত হয় শত বছর পূর্ব থেকেই। তাই বর্ষা বাংলার চিরন্তন রূপ।
আমাদের শৈশবে ‘ রেইন রেইন গো এওয়ে’ লিরিক শেখানো হতো। তারণ্যে এসে রবির ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনের’ গানের সুমধুর ধ্বনি বাঙালি হৃদয়ে যেমনি বাজে, তেমনি নজরুলের ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দেরে তুই’ আব্বাস উদ্দিনের দরদী কণ্ঠে বাঙালিদের বৃষ্টির জন্য কাতরতার বহিপ্রকাশ। প্রাচীন রোমে বৃষ্টির দেবতা জুপিটার প্রæভিয়াস এর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা অথবা বৃষ্টির জন্য নানা তুকতাক, যপমন্ত্র, অর্চনার দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বে মেঘবীজবপন বা ক্লাউড সিডিং প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি ঝরানো পদ্ধতির দেখা মেলে। এ বিষয়ে চীন বিশ্বে এখন অগ্রগামী। অথচ শৈশবের ‘বৃষ্টিপড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’ মুখস্ত করার দিন শেষ। তবে কী বৃষ্টির জন্য প্রতিক্ষার দিন শেষ হতে চলেছে। হয়ত না ক্লাউড সিডিং মানুষের প্রতীক্ষার বৃষ্টি ঝরাতে পারবে না। হয়তো কোথাও কোথাও ক্ষেত্র বিশেষে বৃষ্টি ঝরাতে সক্ষম হবে।
মানুষের মনে আজন্ম লালিত বৃষ্টির প্রতীক্ষা তাঁর অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। তাইতো বাঙালি হৃদয়ে বেড়ে উঠে ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না/আমার এত স্বাদের কান্নার দাগ ধুয়ো না / সে যেন এসে দেখে / পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি। বাঙালি হৃদয়ের প্রাণের এই আকুতি যুগ যুগ ধরে বহাল ছিল থাকবেই। শস্য শ্যামলার বাংলার মাটিতে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ুক এই আমাদের কামনা। বৃষ্টি তুমি এসো। যে যাই বলুক আমাদের ভূমিও মনোভূমি সতেজ করতে তোমাকেই চাই। এবারের মৌসুমী বায়ুর সাথে বৃষ্টি ঝরার তাল ও লয় দেখে কাউছার আহমেদের কথায় শিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর দরদী কণ্ঠের ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়’ গানটি বার বার বেজে উঠছে। বলা যায় বাঙালির বৃষ্টির প্রতীক্ষা শুধু অঝোর ধারায় জল পড়া নয়। এ বৃষ্টির শব্দে তার প্রিয়ার কথা ও মনে পড়ে। তার বিরহে কাতর হয়। আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেবো মেপে। বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতিতে বৃষ্টি আমূল গেঁথে আছে।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)