জাকেরুল হক চৌধুরীর মত নেতারা ছিলেন আওয়ামী লীগের সম্পদ

6

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

চট্টগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির একটি বিখ্যাত নাম জাকেরুল হক চৌধুরী। ১৯৪৯-৫০ সালে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠানকালে তিনি এই দলে দাখিল হয়ে দলের সুদিনে-দুর্দিনে নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে জীবনভর আওয়ামী লীগই করেছেন। একদিনের জন্যও আওয়ামী লীগের হাল ছাড়েননি, অন্য দল করেননি। আওয়ামী লিগার পরিচয় নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এমন আদর্শবান, বিশ্বস্ত নেতারাই একটি দলের জন্য পরম সম্পদ হিসেব বিবেচিত হয়।
এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, সালারে জিলা, আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা এ আর চৌধুরী, ইউনুছ খান, ডা. শামসুল আলম চৌধুরী, মওলানা ছালেহ জহুর, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদীর পর সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, অধ্যাপক মওলানা নুরুল ইসলাম, সুলতান কন্ট্রাক্টর, ইউসুফ মিয়া, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, কবির উদ্দিন বিএ, এম এ হান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আবদুল্লাহ আল হারুন, মানিক চৌধুরী, ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, এমএ মান্নান, এমএ ওহাব, অ্যাডভোকেট বদিউল আলম, সিরাজ মিয়া, ফিরিঙ্গীবাজারের দোভাষ বংশের ফুল জানে আলম দোভাষ, হারবাং-এর ডা. আনোয়ার হোসেন, শরীয়তুল্লাহ সওদাগরের প্রপৌত্র এম এ গণি (পরে লন্ডন প্রবাসী), হাতি কোম্পানির নাতি ও খান সাহেব আবদুল হালিম চৌধুরীর পুত্র চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, অকাল প্রয়াত চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর পিতা তারিক আহমদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট অধ্যাপক খান শফিকুল মান্নান, এ কে এম আবদুল মান্নান, ইসহাক মিয়া, মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী, এম ছিদ্দিক, চাচা খালেক, খড়ম ছালেহ, মোহাম্মদ ছালেহ, এম এ আজিজের খালাতো ভাই ‘মাইক এজাহার’, ‘বাংলাবাজারের ত্রিমূর্তি’ বজল মিয়া, বালির বাপ ও আবুল খায়ের চৌধুরী প্রভৃতি নামের সঙ্গে জাকেরুল হক মিয়ার নামও এক নিঃশ্বাসে উচ্চার্য। এঁরাই ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শক্তি বা ভিত্তি। এই তালিকার শেষে আরো যোগ করা যায় এসব নাম-সীতাকুÐের এম এ মামুন, ডা. এখলাছউদ্দিন, স›দ্বীপের রেদওয়ানুল বারী, ওবায়দুল হক, ফটিকছড়ির বাদশাহ আলম, রাউজানের ডা. এ কে এম আবু জাফর, ডা. জাকারিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক আবু তাহের রিজভী, সাধন কুমার ধর, নুরু মিয়া মাস্টার, রাঙ্গুনিয়ার খলিলুর রহমান ও জহির চেয়ারম্যান, বোয়ালখালীর ডা. মান্নান, আনোয়ারার ইদ্রিস বি.কম প্রমুখ।
শহরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জিরোনোর জন্য, গল্প-গুজব বা আড্ডা দেয়ার জন্য আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিস ও রেস্ট হাউসের জহুর আহমদ চৌধুরীর দপ্তর ছাড়াও কতগুলি নির্দিষ্ট স্থান ছিলো। এর মধ্যে জাকেরুল হক মিয়ার আমানিয়া হোটেলও একটি অবশ্য গন্তব্যস্থল ছিলো। অন্যান্য গন্তব্য হলো-আন্দরকিল্লা মিয়া ফারুকীর চট্টল লাইব্রেরি, ফিরিঙ্গীবাজারে জানে আলম দোভাষের বাসভবন ‘দোভাষ হাউস’। আর হ্যাপী লজ, নোভেলটি, বোস ব্রাদার্স, মিসকা ছিলো অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা-কর্মীদের আড্ডাস্থল। আমানিয়া মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু, আজিজ-জহুর থেকে বদি, বদন, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, ইদরিস আলম, আশরাফ খান, মোখতার আহমদ, এস এম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কখনো বা সুলতান উল করিব চৌধুরীরও গন্তব্য হয়ে উঠতো।
জাকেরুল হক চৌধুরী বাঁশখালী থানার সাধনপুর গ্রামে একটি সম্পন্ন ভ‚মিজীবী পরিবার থেকে শহরে এসে পরিবারটিকে একটি ব্যবসায়িক পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশভাগের পরপরই আওয়ামী লীগের জন্ম আর জাকেরুল হক মিয়াও তার কিছু আগে শহরে এসে লালদিঘিতে হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৪ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভা কার্যালয় লালদিঘি থেকে আন্দরকিল্লা চলে গেলেও শহর-কেন্দ্র তখনো লালদিঘির পাড়েই ছিলো। কক্সবাজার বাস স্ট্যান্ড, জেলখানা, এন্তেকালী অফিস, ব্রিটিশ কাউন্সিল, মিউনিসিপাল লাইব্রেরি, অদূরে কোর্ট বিল্ডিং-এ আদালত ও জেলা প্রশাসনের অফিস ইত্যাদি নিয়ে তখনো জমজমাট লালদিঘি এলাকা। নিওন সাইন শোভিত বিপণির সমারোহ তো ছিলোই। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ের দক্ষিণে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্রদের খেলার মাঠটি জনসভায় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। আর জনসভার মঞ্চ হতো অর্থাৎ লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ের রাস্তাসংলগ্ন মাঠের উত্তর প্রান্তে। জনসভারকারণে লালদিঘির পাড় জনআকর্ষণের আরো কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলো। ইতিপূর্ব জনসভা হতো আন্দরকিল্লা পুরোনো মুসলিম হল ময়দানে (বর্তমানে জেমিসন মেটারনিটি ও রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল)। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী এসে সেখানে বক্তৃতা করে যাওয়ার পর থেকে সেটার নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘গান্ধী ময়দান’। পাকিস্তান হওয়ার সময় মুসলিম হল কে সি কে রোডের নন্দন কানন এলাকার বর্তমান স্থানে চলে আসে। ফলে জনসভার জন্য বিকল্প স্থানের প্রয়োজন দেখা দিলে লালদিঘি মাঠ শূন্যস্থান পূরণ করে। পশ্চিম পাকিস্তান ও ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নেতারা চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বক্তৃতা করতে আসতেন। তাঁরা এবং তাঁদের শ্রোতা-দর্শকদের চা-নাস্তা, ভাত-পানি পাওয়ার জন্য হোটেল-রেস্তোরাঁরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। জাকেরুল হক মিঞা ঠিক এই মোক্ষম সময়টিতেই লালদিঘির পাড়ে তাঁর হোটেল রেস্তোরাঁ খুলে বসলেন এবং অচিরেই বাজিমাৎ করে ফেললেন। রাত্রিযাপনের জন্য রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন হোটেলেরও আবশ্যকতা ছিলো। জাকেরুল হক মিঞার ‘আমানিয়া’ সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয়েছিলো। ইসলাম মিয়া, আবদুল মাবুদ সওদাগর ও সবদর আলীদের তারকা হোটেলগুলি তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। স্টেশন রোডে বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন স্থানে বাঁশখালীর কালীপুরের এন্তু মিয়া ও পাথরঘাটার কবির মিয়া শরিকি মালিকানায় ওয়ালেস হোটেল নামে যে হোটেলটি করেছিলেন, সেটিও ততদিনে উঠে গেছে।
মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবু হোসেন সরকার, নান্না মিয়া, শামসুল হক, তাজউদ্দীন, আবদুল জব্বার খদ্দর, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ওয়ালী খান, আবদুর রব নিশতার, কিজিলবাস, জিএম সৈয়দ, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রভৃতি নেতারা আসতেন লালদিঘি মাঠে বক্তৃতা করার জন্য। তবে আমানিয়া হোটেল জাকেরুল হক মিয়ার প্রসিদ্ধির কারণ হলেও তাঁর মূল অবদান ছিলো রাজনীতিতে। তাঁর আরো বৃহত্তর ও শ্রেয়তর পরিচয় ছিলো। খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, প্রসিদ্ধ সমাজহিতৈষী। মানবদরদী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলে তিনি। তবে এখন যেহেতু আওয়ামী লীগের যুগ, প্রায় বিশ বছর ধরে দলটি ক্ষমতায়, তাই জাকেরুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ছিলেন, সেই পরিচয়টাই আগে দেওয়া যাক। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গৌরবময় ঐতিহ্য যাঁরা নির্মাণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে জাকেরুল হক চৌধুরী একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা। জাকেরুল হক চৌধুরী বাঁশখালী থানার সাধনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী, মাতা মোস্তফা বেগম। পিতামহ আলি মিয়া চৌধুরী। জাকেরুল হক চৌধুরী নিজ গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। পরে বাণীগ্রাম ও বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
তিনি প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম শহরে লালদিঘির পাড়ের সুবিখ্যাত ‘আমানিয়া হোটেল’ করে হোটেল রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আরম্ভ করেন। কিছুদিনের মধ্যে হোটেলটি নামকরা হোটেলে পরিণত হয়। ব্যবসা বাণিজ্যে দ্রæত উন্নতির সাথে সাথে তিনি সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি প্রথমবারের মত সাধনপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমানিয়া হোটেল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একটি জনপ্রিয় হোটেল ছিলো। জাকেরুল হক চৌধুরী ব্যবসা বাণিজ্য ও জনসেবার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তৎকালীন সরকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগে যোগদান করেন একথা আগেই বলেছি। অচিরেই তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন থানায় আওয়ামী লীগ সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ ও বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে থাকাকালীন তাঁর অবদান বিরাট ও অনস্বীকার্য।
১৯৬২ সালে আইয়ুব আমলে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার তিনি কুতুবদিয়া, চকরিয়া ও বাঁশখালী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে পুনরায় কুতুবদিয়া, চকরিয়া, বাঁশখালী ও আনোয়ারা এলাকা হতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে) তিনি চীফ হুইপ ছিলেন। উক্ত পরিষদে তিনি বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক হিসেবে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে সংসদ নির্বাচনে মাত্র ১৪৭ ভোটে পরাজয় বরণ করেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে তৎকালীন ৫,০০০ টাকা চাঁদা দেন। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অশংগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের আহŸানে সাড়া দিয়ে তিনি চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম সরকারি খেতাব বর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেট হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সর্বপ্রথম তাঁর আমানিয়া হোটেল আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তী মে মাসের ৫ তারিখে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী বাঁশখালী অভিযানকালে সর্বপ্রথম তাঁর সাধনপুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়। সৈন্যবাহিনী প্রথমে তাঁর পাকা বসতগৃহে ডিনামাইট দিয়ে ও পাউডার ছিটিয়ে এবং পরে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এ সংকটজনক পরিস্থিতিতে তিনি সপরিবারে আত্মগোপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি পুনরায় রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কত ভালোবাসতেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর কত বিশ্বস্ত ও প্রিয়পাত্র ছিলেন তার একটি প্রমাণ হলো-৭০-এ নির্বাচিত এমএনএ এবং ৭৩-এ নির্বাচিত এমপিদের বাদ দিয়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। ঢাকায় গভর্নর ট্রেনিং গ্রহণ করার সময়ে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের মুহূর্তে তিনি গ্রেফতার হন। পরে চট্টগ্রামে এসে তিনি সামরিক বাহিনীর লোকের হাতে পুনরায় গ্রেফতার হয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আটক থাকেন। এত জুলুম অত্যাচারের পরও তিনি কোনদিন নীতিচ্যুত হননি, দল বদল করেননি।
জাকেরুল হক চৌধুরী একজন সুপরিচিত সমাজকর্মী। তিনি ১৯৫০-৫৯ সাল পর্যন্ত সাধনপুর ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ১৯৬০-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বমোট ২১ বছর প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান হিসেবে নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। ইউনিয়ন পরিষদের জন্য নিজস্ব জমি দান করেন ও ইউনিয়ন পরিষদের দালানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ একটি সুন্দর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় নির্মাণ করেন। ১৯৫৪ ও ১৯৬৪ সালে দু’বার শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন পরিষদ সভাপতি ও চেয়ারম্যান হিসাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ‘তমঘায়ে খেদমত’ খেতাব লাভ করেন। ১৯৬১ সালে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার জন্য পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ কর্তৃক তাঁকে সনদ দেওয়া হয়। তিনি আট বছর ছিলেন ইউনিয়ন মাল্টিপারপাস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, চার বছর একাদিক্রমে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি, চার বছর ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্য, চার বছর ছিলেন চট্টগ্রাম জমি বন্ধক ব্যাংকের পরিচালক, তিন বছর ভূমি রাজস্ব উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন, চার বছর মহকুমা কৃষি কমিটির সদস্য, স্বাধীনতা পূর্বকাল পর্যন্ত উপকূলীয় বাঁধ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য, দশ বছর জেলা জজের জুরার, তিন বছর জেলা কারা পরিদর্শক, জেলা আবগারি লাইসেন্স বোর্ডের সদস্য, বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন বহুদিন, জিলা পরিষদের সদস্য, চট্টগ্রাম রাইফেলস ক্লাবের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির কার্যকরী সংসদের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অন্যতম প্রস্তাবক এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা কমিটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি একাত্তর সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তমঘায়ে খেদমত খেতাব বর্জন করেন। তিনি চট্টগ্রামস্থ বাঁশখালী সমিতির সভাপতি ছিলেন। জাকেরুল হক চৌধুরী নিজস্ব তহবিলে একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, একটি পাকা মসজিদ, একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি মহিলা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করে যান। এছাড়াও বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, বাঁশখালী আলাওল কলেজ, সাতকানিয়া কলেজ স্থাপনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তিনি আট বছর সাতকানিয়া মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন।
জাকেরুল হক চৌধুরী সপরিবারে তিনবার হজ্বব্রত পালন করেন। তিনি ৩ পুত্র ও ৪ কন্যার গর্বিত পিতা ছিলেন। তাঁর সন্তানরা সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। পুত্রগণ হচ্ছেন-মঞ্জুরুল হক চৌধুরী-এম.কম, মাহফুজুল হক চৌধুরী এমএ ও মাসুদুল হক চৌধুরী বি.কম। কন্যারা হচ্ছেন-জওশন আরা হক, রওশন আরা আলম, শওকত আরা ও শারমিন আরা। রওশন আরা আলমের স্বামী নুরুল আলম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের অতিরিক্ত মহা পরিদর্শক ছিলেন। তিনি রাঙ্গুনিয়া থানা বিএলএফ (মুজিববাহিনী)-এর কমান্ডার ছিলেন। জাকেরুল হক চৌধুরী ১১ জুলাই ১৯৯৩ সালে পরলোকগমন করেন।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক