দিনে অলিগলি, রাতের শহরে ব্যাটারি রিকশার রাজত্ব!

27

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চট্টগ্রাম শহরে ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচলে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একটু একটু করে বেড়ে শহরে এখন হাজারে হাজারে ব্যাটারি রিকশা চলছে। দিনের বেলায় অলিগলিতে থাকলেও রাতের শহরে প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে সর্বত্রই ব্যাটারি রিকশার রাজত্ব চলে। আর এসব ব্যাটারি রিকশার বেশিরভাগ চালকই শিশু-কিশোর। এই চালকরা রাতের শহরে বেপরোয়া গতিতে রিকশা তো চালাচ্ছেই, জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধেও।
এমন অবস্থার মধ্যে গতকাল ঢাকার মিরপুরে ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে অবরোধ, পুলিশ বক্সে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে চালকরা। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের সচেতন মহলও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
তাদের মতে, এখানে দ্রæতই ব্যাটারি রিকশা বন্ধের ব্যবস্থা না নিলে, তাদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে এক সময় নিয়ন্ত্রণ করা যেমন কঠিন হবে, তেমনিভাবে ঢাকার মতো ঘটনা এখানেও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
তথ্য মতে, ২০১৪ সালে নগরীতে ব্যাটারি রিকশা ছিল ৫-৬ হাজার। ২০২৪ সালে এসে তা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় প্রভাবশালী মহলের নেতৃত্বে এসব রিকশা বিষফোঁড়ার মত ছড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে ধারণক্ষমতা না থাকার কারণে বেশি দিন জব্দ করে রাখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। মূল সড়কে উঠলেই আমরা জব্দ করে ড্যাম্পিং করছি। কিন্তু ড্যাম্পিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে আমরা দীর্ঘদিন জব্দ করে রাখতে পারছি না। ড্যাম্পিং স্টেশন বাড়ানোর জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি এবং সভায়ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখনও আমরা ড্যাম্পিং স্টেশন বাড়াতে পারিনি। যদি ড্যাম্পিং স্টেশনে জায়গার সংকট না থাকতো, তবে বেশ কিছুদিন জব্দ করে রাখতে পারলে এসব রিকশার দৌরাত্ম্য কমতো।
তিনি আরও বলেন, ‘দিন দিন ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে, এটা সত্য। নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে। এখানে আমরা জব্দ করলেই সমাধান আসবে না। আমদানিকারকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তারা যদি আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করে, তবে দৌরাত্ম কমে আসবে।’
এদিকে, নগরীতে যতগুলো ব্যাটারি রিকশা রয়েছে, সেগুলোর চালক বেশিরভাগই কিশোর। তারা দিনের বেলায় বেপরোয়াভাবে রিকশা চালালেও রাতে মদ, জুয়া, গাঁজা ও ইয়াবা সেবনে মত্ত থাকে। এমনকি ওই কিশোরদের বাঁধা দিলে বা প্রতিবাদ করলে দল বেঁধে এসে প্রতিবাদকারীর উপর হামলা চালায়।
ব্যাটারি রিকশা চালকরা মাদক সেবন করতে না পেরে হামলা চালানো নিয়ে গত ১০ মে পশ্চিম বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকার লায়লা বেগম নামে এক মহিলা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘ব্যাটারি রিকশা চালকরা আমার বাসার সামনে বসে গাজা ও ড্যান্ডি সেবন করছিলো। আমি ও আমার মেয়ে প্রতিবাদ করার কারণে আমাকে এবং আমার মেয়েকে চড়-থাপ্পড় দিতে থাকে। এমনকি আমাদেরকে জানে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। সেজন্য আমরা সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
সিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘অপরাধের ধরণ একেক সময় একেক রকম হয়। তাই কিছু কিছু জায়গায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। যেসব আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের অপরাধ পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তারা আগে গ্রেপ্তার হয়েছে কি না, গ্রেপ্তার হলেও কি কারণে গ্রেপ্তার হয়েছে, ইত্যাদি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। গ্রেপ্তার হওয়া আসামি জামিনে মুক্ত হলে তাদের গতিবিধিও আমরা লক্ষ্য রাখছি। প্রতিরাতে আমাদের টহল টিম কাজ করছে। অপরাধ দেখতে পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিশোররা যদি অপরাধে জড়িত হয়, তবে আমরা তাদেরকেও ছাড় দিচ্ছি না। আমরা একটা নতুন উদ্যোগ নিয়েছি, যেখানে কিশোরদের চিহ্নিত করে তাদের বাবা-মা’কে ডেকে সচেতন করা হচ্ছে। এটা নগরীর প্রতিটি থানায় তালিকা করে আলাদাভাবে অভিভাবককে ডেকে সচেতন করা হচ্ছে। যাতে একজনের অপরাধের বিষয় অন্য পরিবার জানতে না পারে।’
আবার ব্যাটারি রিকশার বেপরোয়া গতির কারণে প্রতিদিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে নগরবাসী। কিশোররা রিকশা চালানোর ক্ষেত্রে রাস্তার উভয়দিক, ডান-বাম, সাইট, ওভারটেক কিছুই চেনে না। গত শনিবার দুপুরে ব্যাটারি রিকশা দ্বারা আহত হন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক ও বাংলানিউজের সিনিয়র স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট সোহেল সরোয়ার।
তিনি বলেন, ‘বাকলিয়া এক্সেস রোডে (জানে আলম দোভাষ সড়ক) ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বেড়েছে। আমি ব্যাটারি রিকশার কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে মাথায় আঘাত পাই। তবে সৃষ্টিকর্তার রহমতে বড় কোন ক্ষতি হয়নি।’
একইভাবে গত মঙ্গলবারে জানে আলম দোভাষ সড়কে ব্যাটারি রিকশায় আহত হন পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক ওয়াসিম আহমেদ। দ্রুত ব্রেক কষার কারণে হাতে এবং পায়ে ব্যাথা পান তিনি।
বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ৫০ হাজারের অধিক ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর প্যাডেল রিকশা মালিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অবৈধ রিকশাগুলোকে জব্দ করার নির্দেশ দিলেও ট্রাফিক বিভাগ নামমাত্র জব্দ করছে। যেভাবে জব্দ করার কথা, সেভাবে জব্দ না করে আটককৃত রিকশাগুলো একদিন পর জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। ‘ড্যাম্পিং সংকট’ কথাটিকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে। একদিকে ট্রাফিকও জরিমানা পাচ্ছে, আবার ব্যাটারি রিকশার চালক-মালিকদের মাঝে কোন পরিবর্তন আসছে না। আর গ্যারেজ মালিকরা প্রতিটি রিকশা থেকে দৈনিক চাঁদা (জমা) আদায় করছেন ১৩০ টাকা, যার একটা অংশ পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।’