পূর্বদেশ ডেস্ক
দিনভর নাটকীয়তা ও তৎপরতার মধ্যে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ‘ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে’ কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গতকাল রবিবার রাত ১০টার কিছু আগে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঐক্য পরিষদের তরফে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
এর আগে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অচলাবস্থা নিরসনে দীর্ঘ বৈঠক করে। ওই বৈঠক থেকে ‘ইতিবাচক আশ্বাস’ আসার পর পরিষদ তাদের এতদিনের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরে সব ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি রাত ১০ দিকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় এনবিআরের সংস্কারকে কেন্দ্র করে গঠিত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলেছে, “দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি ও সাপ্লাই চেইন সচল রাখা তথা অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তাদের কমপ্লিট শাটডাউন এতদ্বারা প্রত্যাহার করছে।”
তবে ‘একটি পূর্ণাঙ্গ ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারে আমাদের উদ্যোগ ও কার্যক্রম যথারীতি অব্যাহত থাকবে’ বলে বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরা হয়।
পরিষদের সভাপতি ও মহাসচিব স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে গত কয়েকদিনের কর্মসূচি এবং গতকাল (শনিবার) ও আজ (রোববার) যে কমপ্লিট শাটডাউন তা নিরসনে দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উদ্যোগ ও আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই।
এদিকে সরকার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারে যে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সেটিকেও পরিষদ স্বাগত জানিয়েছে।
“এই কমিটির সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করে টেকসই রাজস্ব সংস্কারে অবদান রাখতে পারবো বলে আমরা মনে করি,” বলেন তারা।
এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকেন দেশের বিভিন্ন কর, ভ্যাট ও কাস্টম অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সকাল ৯টার পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয় রাজস্ব ভবনে প্রবেশ আটকে দিলে সামনেই অবস্থান নিয়ে তাদের কর্মসূচি পালন করতে থাকেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই এনবিআরে প্রবেশে এমন বাধা দেখা যায় আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন বাহিনীর তরফে। রোববারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে সেখানে ছিল।
দুপরের পর থেকেই আন্দোলন থামার একটা ইঙ্গিত মেলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ’র সঙ্গে আলোচনার জন্য আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে যাবেন; বিকেল ৪টায় ওই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
সেখানে কারা যাচ্ছেন তাদের তালিকাও প্রকাশ করা হয় সংবাদমাধ্যমের কাছে পরিষদের তরফে। বৈঠক সামনে রেখে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি সাময়িক বন্ধ রাখেন।
বলা হয়, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়আন্দোলনকারীদের তরফে। তবে তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চালিয়ে যাবেন এর মধ্যে। এতে করে শুল্কায়নসহ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। অর্থ উপদেষ্টা জানান, শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখায় এদিন এনবিআরের আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হচ্ছে না।
সচিবালয়ে যাওয়ার মাঝপথেই আন্দোলনকারীদের ফেরত আসার খবর মেলে তখন।
এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কর্মস্থলে না ফিরলে ‘কঠোর’ হওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে সংস্থাটির সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণারসিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার বলেও তুলে ধরা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ওবৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থেসরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সকল কাস্টমসহাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহেরসকল শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
সরকারের এমন কঠোর অবস্থানে থাকার মধ্যে এনবিআরের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধান শুরুর কথা বলা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তরফে বলা।
যে ছয়জনের বিরুদ্ধে তথ্যানুসন্ধান শুরুর খবর আসে, তাদের পাঁচজনই এনবিআরের চলমান ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির ‘নেতৃত্বে’ রয়েছেন।
রোববার দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক, ভ্যাট ও কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে, নিজে লাভবান হয়ে ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করার মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন-এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ছয়জনের বিরুদ্ধে তথ্যানুসন্ধান কার্যক্রম চলছে।”
এরপর ব্যবসায়ীরা উদ্যোগী হয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেন। উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদেরও সঙ্গে তারা অচলাবস্থার নিরসনে বসেন। বৈঠক শেষে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন তারা। এনবিআর কর্মচারিদের আন্দোলনে শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধের পর এর সমাধানে বিকালে কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন অর্থ উপদেষ্টা।
রোববার বিকালে শুরু হওয়া বৈঠকটি চলে সন্ধ্যা ৭টার পরও। এ সভা থেকে এনবিআরের অচলবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেওয়া হয় ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের।
বৈঠকে অংশ নেওয়া মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা সমস্যার কথা বিস্তারিত বলেছি। সরকারও আন্তরিক সমস্যা সমাধানে। আমরা ব্যবসায়ী হিসেবে সরকারের সঙ্গে থাকব সমস্যা সমাধানে। প্রয়োজনে সরকার চাইলে এনবিআরের কর্মচারীদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে জানাব।’’
এ বৈঠক থেকে আশ্বাসের পর ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে এনবিআরের আন্দোলনরত পরিষদ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।
এ ঘোষণার পর আবার এমসিসিআই সভাপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এখন সরকারের পাঁচজন উপদেষ্টা নিয়ে গঠিত কমিটি এনবিআরের কর্মচারীদের সঙ্গে যৌথভাবে বসবে। আশা করছি আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সব স্বাভাবিক হবে।’’
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এনবিআরের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান ছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সিরামিক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রো চেম্বারের সহসভাপতি সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান অংশ নেন।