মিঞা জামশেদ উদ্দীন
হাতির নিরাপদ করিডর নিয়ে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় এবং একটি জাতীয় দৈনিকে দুটি কলাম প্রকাশিত হয়। দৈনিক ভোরের কাগজ, ৩০ অক্টোবর ২০২৪ইং প্রকাশিত কলামের শিরোনাম ছিল ‘হাতির করিডর স্বাধীনতা।’ ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ইং দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কলামের শিরোনাম ছিল ‘জয়া হাসানের প্রাণী প্রীতি।’ এসব লেখার পরও একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সবার দৃষ্টি কাড়ে। ঢাকাস্থ মুহাম্মদপুরে অবস্থিত জাপানি সিটি গার্ডেনে ৫টি কুকুর ও ১টি বিড়াল হত্যা করার ঘটনা; অভিযোগ ওঠে ওই জাপানি সিটি গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজনের ওপর। বিশেষ করে খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিষ খাইয়ে নির্বোধ প্রাণীদের হত্যা করা হয়। বিগত পাঁচ-ছয় বছর আগেও ঐ প্রাণীগুলোকে হত্যা করতে চেষ্টা করে কমিটির লোকজন। আর ৫ আগস্টের পর, সময়-সুযোগ পেয়েই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করেই ছেড়েছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নায়িকা জয়া হাসান নিরীহ এ সকল প্রাণী হত্যার প্রতিবাদ করেন। ২৩ নভেম্বর ২০২৪ইং নায়িকা জয়া হাসানের সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে এবং একটি জাতীয় দৈনিকে তাঁকে সহ খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। অপর ঘটনাটি হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানি, কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেট) নামে চট্টগ্রামের আনোয়ারা- কর্ণফুলীর দেয়াং পাহাড়ে কয়েক হাজার একরের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি বনাঞ্চল দখল করে নেয়। এটি পাহাড়ি-টিলা বেষ্টিত সবুজ ঘন-অরণ্যভূমি। ওই বনে আগ থেকে হাতির অভয়ারণ্য ছিল। ওই কেইপিজেডের লাগোয়া পালকি চর অবস্থিত। ২০২৩ সালের দিকে পালকি চরে যাওয়া হয়। তখন বিস্তীর্ণ ওই পাহাড়ী-অঞ্চল সরজমিনে দেখার সুযোগ হয়। কথা হলো, হাতির নিরাপদ করিডরে কেন এসব স্থাপনা; যা কিনা পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠেছে। এককথায় বলা যেতে পারে, পরিবেশের ভারসাম্য হারাতে বসেছে। অবশ্য এরমধ্যে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দলবল নিয়ে পরিদর্শনে আসেন। তিনি হাতির করিডর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু প্রদক্ষেপ নেন। সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বনপ্রহরীদের বনাঞ্চল রক্ষনাবেক্ষণে আরো সচেষ্টতা হতে তাগাদা দেন। কিন্তু কিছুদিন পর দেখাগেল তার উল্টো চিত্র। কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় ও দেয়াং পাহাড়ে বন্যপ্রাণীর যে অবস্থান ছিল তাদের চ‚ড়ান্তভাবে খেদিয়ে দিয়েছে। স্থানীয়দের মতে, মা-বাচ্চা মিলেই ১৩টি হাতির অবস্থান বা সন্ধান দেখে আসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে হাতিগুলো লোকালয়ে হানা দিয়ে কৃষকদের ফসলাদি বিনষ্ট করাসহ জনবসতির ওপর হুমড়ি খেয়ে-পড়ার ঘটনাও ঘটতো। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতো। এখন কথা হলো, বনের নিরীহ প্রাণী জনবসতির ওপর কেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে; এ কারণটাও একবার বিশ্লেষণ করা উচিত — আজ প্রাণীদের অভয়ারণ্য হুমকি সম্মুখীন এবং খাদ্যাভাবেও তীব্রতর, অর্থাৎ খাদ্যাভাবে হাতির পাল লোকালয়ে হানা দেয়। আর এর অন্যতম কারণ হল নির্বিচারে বন ওজার করাসহ পাহাড়-ঢিলা সমানে দখল-বেদখ চলছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, এ সংরক্ষিত বনাঞ্চল একটি বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেয়া। তারা প্রতিনিয়ত পরিবেশ অসহনীয় কাঠামো ও অবকাঠামো গড়ে তোলতে থাকে। যারফলে এ ঘনবন দিনদিন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়। এ অবস্থায় হাতির করিডর বা অভয়ারণ্য হারাতে বসেছে। ইদানিং যে ঘটনাটি নজরে এসেছে। চলতি বছরে মার্চের শেষদিকে, হাতির উৎপাত বন্ধ করার নামে কিছু লোকজনকে প্রতিবাদ সবর হতে ও সড়ক অবরোধ করতে। একইসঙ্গে তারা স্মারকলিপিও দেয় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে। তাদের দাবী ছিল, হাতির উৎপাত বন্ধ করতে হবে। তবে জণগণের এ দাবির সাথে কারো দ্বিমত করার কথা নয়। হাতির উৎপাত বন্ধ করতে হলে প্রথমত যে কাজটি করা উচিত ছিল, হাতির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা এবং বন উজাড় বন্ধ রাখা। সাথে গড়ে উঠা সকলপ্রকার কাঠামো-অবকাঠামো স্থাপনা উচ্ছেদ করে পুনরায় বনায়ন করা। কিন্তু সেটি না করে পাহাড় থেকে হাতি খেদানোর দৃশ্য দেখা গেল! মা-বাচ্চা মিলে তিনটি হাতিকে তাড়া করে। তারা এ-ও দাবি করে, এ বনে থাকা অবশিষ্ট হাতি সরে গেছে অদূরে। ঘটনাটি কিছু গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। তবে দৃশ্যমান ছিল তিনটি হাতি। তারাও স্বীকার করে তিনটি হাতি খেদানোর কথা। এ ঘটনার যে বা যারা করেছেন, তারা ছিল বিক্ষুব্ধ জনতা এবং তাদের পক্ষের লেলিয়ে দেয়া লোকজন। কিন্তু তারা একসময় দাবিসহকারে এ-ও বলাবলি করতে থাকে- কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় ও দেয়াং পাহাড়ে মা-বাচ্চা মিলেই তেরটি হাতি অবস্থান। তাদের আগমনের কথাও এক আরব্য রূপকথার কাহিনির মতো। যাক, সেদিকে আর যাবো না— তিনটি হাতি আবাসস্থল ছেড়ে যেতে দেখা গেছে বলে দাবি করা হলেও বাকী হাতির পাল গেল কোথায়, তা তারা জানায় নি। তাহলে এখানে সন্দেহের দানাবাঁধে; নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে, তিনটি হাতিকে সাউন্ডবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয় দেখিয়ে খেদানো হয়েছে, অপর হাতিগুলোকে হত্যা করা হয়েছে? অবশ্য বিষয়টি তদন্তসহকারে খতিয়ে দেখা উচিত। অন্যথায় পরিবেশ সহনীয়-প্রাণীগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়বে। যারফলে পরিবেশের ভারসাম্য হারাতে বসবে। দেশটা-ই হয়ে উঠবে বসবাসের উপযোগী। আর এ জন্য প্রয়োজনে পরিবেশবিদ ও প্রাণী প্রেমিকদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা অত্যাবশক। না হয় নিরীহ হাতিগুলোকে গুলি করে বা বিষ প্রয়োগে হত্যা করে পুঁতে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা!
ঢাকাস্থ জাপানি সিটি-গার্ডেনে প্রাণী হত্যার ঘটনাও দামাচাপা পড়েছে মনে হয়। এ ঘটনার আপগ্রেড কি তা জনসম্মুখে নেই; এসব ঘটনা দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না হলে একের পর এক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এবার বলাযাক মানবিক করিডর বিষয়ে। মানবিক এ করিডর নিয়ে দেশের জনগণও একাট্টা এবং হাঁপিয়ে- ফুলিয়ে উঠেছে। সর্বত্র এ নিয়ে কথা চলছে। দেশের মানুষ এক কর্নাবিন্দু মাটি পর্যন্ত হাতছাড়া করতে রাজি নয়। খোদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থক-শিবির থেকেও এ দাবি জোরালো হয়ে ওঠেছে। শেষতক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারাও আগের কথা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। দেশের মানুষ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়Ñ এটি যে হুমকির মুখে পড়বে সার্বভৌমত্ব, একজন উম্মাদও বুঝতে পেরেছে! এমনিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জন্য দেশর দক্ষিণাঞ্চল ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। কাগজে-কলমে ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আজ উদ্বাস্তু হিসেবে রয়েছে। এটি যে কতবড় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, সেখানে কেন আবার মানবিক করিডর? দেশটা তো রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডর হয়েই আছে। তাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চিতা করতে সকলপ্রকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে কোনোপ্রকার চাপ বা বল প্রয়োগ করা হচ্ছে না, এমন কি বাধাঁ দেয়ারও ঘটনা নেই। তাহলে যেকোনো দেশ বা মানবিক সংস্থা যখন-তখন মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা দিতে আসতে আপত্তি কোথায়? আর সেখানে টেকনাফের শিলখালিকে এ মানবিক করিডোরের প্রস্তাবনা অযুক্তিক নয় কী। বরঞ্চ মায়ানমারের রাখাইনরাজ্যে, যেখানে মায়ানমারের জান্তাসরকারের সাথে রাখাইনদের সশস্ত্র গ্রুপের যুদ্ধ চলছে। এটি আমরা তাদের গৃহযুদ্ধ বলতে পারি। অথচ সেখানে এখনো স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হওয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা চরম অবহেলিত। তাদের মানবিক সাহায্যে জন্য রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর চাইতে পারে, জাতিসংঘ ও মার্কিনরা। সেটি না করে কেন এ অযাচিত আচরণ; তবে মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে, গ্রুপ ও উপ-গ্রুপের মধ্যে সংঘাত হয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের দেখতে এসে রোজাদার মুসলিমদের সাথে ইফতার করেন এবং তাদের আশ্বস্ত করেন, শীঘ্রই তাদের নিজ দেশে প্রত্যবর্তন শুরু করার বিষয়ে সচেষ্ট হবেন বলে। রোহিঙ্গারা এ আশায় বুক বেঁধে আছেন। আর সেখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। মানবিক করিডোরের নামে যেকোন অপতৎপরতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে যে দুটি বন্দর বা পোর্ট রয়েছে, সে দুটি চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা এ পোর্ট হাতছাড়া করতে চাইবে না। চীনের বাণিজ্য প্রসারে রাখাইনের সিউওয়ে পোর্ট ও কিয়াউকপিউ পোর্ট শক্ত অবস্থান রেখেছেন। মার্কিনরা মানবিক করিডর নামে রাখাইনে ওই দুই পোর্টও নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছে। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরসহ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে স্থায়ীভাবে মার্কিন নৌ-ঘাঁটি প্রদর্শীত হবারও সম্ভবনা রয়েছে। বুঝতে হবে, মার্কিনদের-এ অবস্থা কোন মানবিক করিডরের জন্য নয়, ইন্দো-প্যাসিফিক জোন নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে। আরেকটি বিষয় হয়তো আমরা ভুলে গেছি, মার্কিনদের এ বিশাল নৌ- বাহরের ব্যয়ও কিন্তু এ বন্দরের ওপর পড়বে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ বিশাল ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এখনো মার্কিন থাপা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরকে রক্ষা করার দাবি-ওঠা উচিত নয় কী? ইতোমধ্যে মার্কিনদের মানবিক আচার-আচরণ স্পষ্ট বিশ্ববাসীর কাছে। তাদের সামর্থ্য ও শক্তি দু-ই আছে। তাদের উচিত যুদ্ধকবলিত নিরীহ ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো এবং মানবিক করিডর স্থাপন করা। দখলদার ইসরাইয়েল বাহিনীর তাÐব বিশ্ববাসী স্তম্ভিত! একমুঠো খাবার, এক ফোঁটা পানি, মাথার ওপর একটুকরো ছাউনি বড়োই প্রয়োজন।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট