রিয়াজউদ্দিন বাজারে অগ্নিকান্ড জনসচেতনতার বিকল্প নেই

3

 

দেশে অগ্নিকান্ড ঘটে প্রায়ই। অগ্নিকান্ড হতে রক্ষা পেতে যেরকম জনসচেতনতা প্রয়োজন তা নিয়ে আমরা বহুবার লিখেছি। মানুষের মধ্যে অগ্নিকান্ডপূর্ব সচেতনতা তেমন সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে না। আমরা স্ব-স্ব অবস্থানে অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে সতর্ক হলে বহু দুর্ঘটনা হতে রক্ষা পেতে পারি। ঢাকা চট্টগ্রামের বহু ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার পরও দেশের মানুষ সতর্ক ও সচেতন না হওয়ায় আরো দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন রিয়াজউদ্দিন বাজারে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আগুনের ধোঁয়ায় দমবদ্ধ হয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন সাতকানিয়ার বাসিন্দা মো. রিদুয়ান (৪৫), মো. শাহেদ (২৮) ও ইকবাল (২৬)। এছাড়া এ ঘটনায় আরও ২ জন আহত হন বলে জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে মোহাম্মদী প্লাজার ব্রাদার্স টেলিকম নামে একটি মোবাইল এক্সেসরিজের দোকানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পাশের রিজওয়ান কমপ্লেক্সে ছড়িয়ে পড়ে।
বৃহত্তম পাইকারি পণ্যের বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ভবনের পাশাপাশি বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে স্থাপনাগুলো রীতিমত মৃত্যুক‚পে পরিণত করা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্তরোত্তর প্রসার ঘটলেও স্থাপনাগুলোতে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসের গরজবোধ করেনি কেউ। ফলে দুর্ঘটনা দিনে দিনে অনিবার্য পরিণতি লাভ করেছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের সেফটি প্ল্যান অনুযায়ী, নগরীর বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ বহুতল ভবনগুলোতে থাকার কথা দুটি পৃথক সিঁড়ি, হাইড্রেন্ট, হোস পাইপ, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ, রাইজারসহ অগ্নিনির্বাপনের জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরিদর্শনকালে বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে নয়শ’ ২৪টিতে এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাছাড়া বহুতল ভবনগুলো আবাসিক এলাকায় হলে সেগুলোর সার্বিক সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ২০ ফুট প্রশস্ত সড়ক প্রয়োজন। আর বহুতল ভবনগুলো বাণিজ্যিক এলাকায় হলে সড়ক হতে হবে ৩০ ফুট প্রশস্ত। অগ্নিনির্বাপক গাড়ি নিয়ে দমকল কর্মীদের দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে এমন সড়কের দরকার। কিন্তু নগরীর বেশির ভাগ বহুতল ভবনই গড়ে তোলা হয়েছে এ নির্দেশনা না মেনে। এতে করে অগ্নি-দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে গিয়ে তা নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, রাত ১টা ৩৫ মিনিটে আগুন লাগার খবর আসে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। খবর পেয়ে আগ্রাবাদ, নন্দনকানন, চন্দনপুরা ও লামারবাজার ফায়ার স্টেশনের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। পাশাপাশি দুটি মার্কেট। ঢোকার রাস্তা সেভাবে নেই, একেবারেই অপ্রশস্ত। এ জন্য আমাদের কাজ করতে খুব সমস্যা হয়েছে। প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর সাড়ে পাঁচটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে, ঘটনাস্থল থেকে প্রথমে একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর ৩ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে আরও ২ জন মারা যান। আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। চার তলা একটি মার্কেটের দ্বিতীয় তলার এক দোকানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত করে জানা যাবে।
অগ্নি-দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকির তালিকায় থাকা রেয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে ছোট-বড় একশ’ ৪০টি মার্কেটে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। বেশিরভাগ দোকানে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী, কাপড় ও ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রি করা হয়। মার্কেটের গলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে মানুষের হাঁটা-চলারও সুযোগ নেই। কোথাও দখল করে নেওয়া হয়েছে গলির একাংশ। কোথাও চলাচলের পথেই অবৈধভাবে দোকান তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটা যায় না- এমন গলিপথও রয়েছে কোনও কোনও মার্কেটে। এসব মার্কেটে কখনো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি-নির্বাপক গাড়ি ও দমকল কর্মীদের প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মার্কেট ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। মার্কেটের ওপরের তলার কক্ষগুলো গুদাম এবং আবাসিকের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া মার্কেটের ভেতরে বা আশপাশে আগুন নেভানোর মত পানির কোনও উৎস নেই। রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। এ কারণে মধ্যরাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসারও সুযোগ নেই। এ জন্য রিয়াজুদ্দিন বাজারের পরিবেশ অনুকুলে আনা জরুরি। জনসচেতনতা এবং অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে দেশে অগ্নি-দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যুর হার কমতে বাধ্য।