কিডনির ক্যানসার নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

4

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ

কিডনি আমাদের শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রত্যেক মানুষের শরীরে দুটি করে কিডনি থাকে। এর আকার খুব বড় নয় কিন্তু এর কাজ ব্যাপক। যেমন- কিডনি আমাদের শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে। কিডনি অকেজো হলে শরীরে দূষিত পদার্থ জমে যায়, ফলে নানান উপসর্গ দেখা দেয়। কিডনি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে যা শরীরের অন্যান্য ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরে রক্ত তৈরি করা। তাই কিডনি অকেজো হলে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং রক্তচাপ বাড়ে। কিডনি আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ইলেকট্রোলাইট (ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম) এর সমতা রক্ষা করে। কিডনি কাজ না করলে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায় যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। কিডনি অসুখকে নীরব ঘাতক বলা হয়। চুপিসারে এই রোগ আপনার শরীরে বাসা বেঁধে ধ্বংস করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে কিডনি ডেমেজ ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাকের পর অবস্থান করছে। শুধু আমেরিকাতে প্রায় ২৬ মিলিয়ন মানুষ কিডনি সমস্যায় ভুগছেন।

কিডনির ক্যানসার হওয়ার কারণ : ক্যানসার বিশৃঙ্খল ও অনিয়মিত কোষ বিভাজনঘটিত এক মারাত্মক রোগ। এ রোগের ম্যালিগন্যান্ট কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে ওঠা টিউমার সুস্থ কোষগুলো হটিয়ে আক্রান্ত প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক ক্রিয়া কর্মে বাধা সৃষ্টি করে। ম্যালিগন্যান্ট কোষগুলো তাদের অবস্থানের জায়গা থেকে রক্তপ্রবাহ বা লসিকাতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। ক্যানসার অনেক ধরনের। নানা কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এ মরণব্যাধি। কিডনিও আক্রান্ত হতে পারে ক্যানসারে। এ ক্ষেত্রে কিডনির কোষের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত রেনাল টিউবিউলে সৃষ্ট রেনাল সেল কারসিনোমা নামক এক ধরনের কিডনির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বংশের কারো কিডনির ক্যানসারের ইতিহাস থাকা, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, অতিরিক্ত ওজন ও ডায়ালিসিসযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ কিডনির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা সাধারণত উইলমা টিউমার নামক এক ধরনের কিডনির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
রেনাল সেল কারসিনোমার কারণ স্পষ্ট নয়। তবে কিছু কিডনির কোষের ডিএনএতে রূপান্তর (মিউটেশন) ঘটলে কিডনির ক্যানসার হয়ে থাকে। এ মিউটেশন কোষগুলো দ্রহত বৃদ্ধি ও বিভক্ত হওয়ার জন্য সংকেত প্রদান করে। এ অস্বাভাবিক কোষগুলো টিউমারের সৃষ্টি করে, যা কিডনির বাইরেও প্রসারিত হতে পারে। এর মধ্যে কিছু কোষ বিস্তৃত হয় এবং শরীরের দূরবর্তী অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিডনির সাংঘাতিক টিউমার। কিডনি নিজেই বেশিরভাগ কিডনি ক্যানসারের উৎপত্তিস্থল। খুব কম ক্ষেত্রে অন্য অঙ্গ থেকে ক্যানসার কিডনিতে ছড়াতে পারে।

কিডনির ক্যানসারের প্রকার : ৩টি প্রধান প্রকারের কিডনি ক্যানসার আছে।

১) মূত্রাশয় কোষে কার্সিনোমা : ইহা হাইপারনেফ্রোমা বা অ্যাডেনোকারসিনোমা নামেও পরিচিত। প্রায় ৭৫% কিডনি টিউমারই এই প্রকারের। ইহা ৪০ বছরের অধিক ব্যক্তিদেরই সাধরণত হতে দেখা যায়। পুরুষেরা মহিলাদের তুলনায় অধিক আক্রান্ত হয়। ইহার অতি সাধারণ লক্ষণ হল রক্তমূত্র। কোমরে যন্ত্রণা, তলপেটে পিন্ড ও জ্বরসহ ওজন হ্রাস পায়। টিউমার ফুসফুস, হাড় যকৃৎ এবং মস্তিষ্কে বিস্তার লাভ করার ফলে কোন কোন রোগীর মৃত্যু ঘটে।

২) নেফ্রোব্লাসটোমা : ইহাকে উইলমস টিউমারও বলা হয়। ৫ বছরের নিচের শিশুদের ক্যানসারের প্রায় ১০% এই ধরনের। উক্ত বয়সের পরে এই রকম ক্যানসার বিরল। ইহা দ্রæত বৃদ্ধি পায়। ফলে তলপেটে পিন্ড বা দলা অনুভ‚ত হয়। এই ক্যানসার মাঝে মাঝে পেটে যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। ফুসফুস, লিভার এবং মস্তিষ্কে ইহা বিস্তার লাভ করে।

৩) ট্রানজিশনাল সেল কার্সিনোমা : মূত্রাশয়ের পেলভিসের অভ্যন্তরীণ আবরণের কোষ থেকে এই প্রকারের কিডনি ক্যানসার হয়। তামাক ধূমপানকারী ব্যক্তিও বছরের পর বছর ধরে যারা অতি মাত্রায় অ্যানালজেসিক যন্ত্রণা উপশমকারী ওষুধ গ্রহণ করে তাদের এই প্রকারের কার্সিনোমা হতে দেখা যায়। সাধারণ লক্ষণ রক্তমূত্র। মূত্রনালি অবরুদ্ধ হয়ে (হাইড্রোনেফ্রোসিস মূত্রসহ কিডনির সফীতি) হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় টিউমার নির্ণয় ও চিকিৎসার উপরে বেঁচে থাকার হার সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে।

কিডনির সিস্ট বা কিডনির পুঁজ কোষ : কিডনির অভ্যন্তরে তরল রসে পূর্ণ থলি। বেশির ভাগ কিডনি পুঁজকোষই ক্যানসার প্রকৃতির নয়। কিছু ক্ষেত্রে একটি বা উভয় কিডনিতেই বহুসংখ্যক পুঁজকোষ দেখা যায়। বেশিরভাগ কিডনি পুজঁকোষেরই কোন জানা কারণ নেই। সাধারণত কোন লক্ষণও প্রকাশ করে না। কিন্তু যথেষ্ট বড় হয়ে চাপের ফলে পিঠের নিম্নাংশে ব্যথা সৃষ্টি করে। কিডনি পুঁজকোষ থেকে পলিসিস্টিক কিডনি জিজিজও হয়। ইহা একটি বংশগত দশা বা অবস্থা। প্রায়ই ৫০ বছরের নিচের ব্যক্তিদের কিডনি অকৃতকার্যতায় এই দশা নেতৃত্ব দেয়।
কিডনির ক্যানসারের লক্ষণ : কিডনি ফুলে যায়, প্রস্রাব আটকে যেতে পারে, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে, প্রসেস্টের বিভিন্ন সমস্যা, রাতে অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ, অনৈচ্ছিক মূত্রত্যাগ, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, গলা দিয়ে তরল নির্গত হয়ে থাকে, কুঁচকি ফুলে যায়, মল দেখতে অস্বাভাবিক লাগা, বিছানায় মূত্রত্যাগ ইত্যাদি।
রোগ নির্ণয় : আলট্রাসাউন্ড, সি.টি.স্ক্যানিং এম.আর.আই বা ইন্ট্রাভেনাস ইউরোগ্রাফি দ্বারা রোগ নির্ণয় করা হয়।
পরামর্শ : এ রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। এজন্য যা করতে হবে তা হলো-
* ধূমপান ত্যাগ করা : ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা আপনাকে ত্যাগ করতেই হবে। ছাড়া সম্ভব না হলে এ ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
* ফল ও শাকসবজি গ্রহণ : খাদ্যতালিকায় বেশি বেশি ফল ও শাকসবজি রাখুন। বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাকসবজি গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় সব নিউট্রিয়েন্ট পেতে সাহায্য করবে।
* ওজন নিয়ন্ত্রণ : শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ওজন বেশি হলে প্রতিদিন কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ওজন কমানোর অন্যান্য পদ্ধতি সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
* উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ : উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন চিকিৎসকের সঙ্গে। ব্যায়াম, ওজন কমানো এবং খাদ্যাভ্যাস এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে।
* হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : কিডনির ক্যানসার অত্যন্ত জটিল রোগ। এতে ওষুধ নির্বাচন করা এত সহজ নয়। অত্যন্ত বিছক্ষণতার সাথে লক্ষণভেদে নির্দিষ্ট মাত্রায় নি¤œলিখিত ওষুধ ব্যবহার যেতে পারে। যথা- ১) আর্সেনিক, ২) ক্যালকেরিয়া, ৩) কার্সিনোসিন, ৪) ক্রোটিলাস, ৫) কেলি সালফ, ৬) কোলিয়াস, ৭) ক্যান্থারিস, ৮) কোনিয়াম, ৯) স্যাবাল সেরু, ১০) বার্বেরিস, ১১) হাইড্র্যাস্টসি, ১২) ফেরাম ফস, ১৩) ফসফরাস, ১৪) কোলিয়াস, ১৫) এপিস, ১৬) ক্রোকাস স্যাট, ১৭) ক্রিয়োজোট, ১৮) ক্যালেন্ডুলা, ১৯) হোয়াং নান, ২০) থুজা, ২১) ল্যাকেসিস উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।

লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক