মাকে ‘খুন’ করে ‘মুক্ত’ হতে চেয়েছিল মেয়েটি!

4

পূর্বদেশ ডেস্ক

ইচ্ছামত চলাফেরা ও শখের কাজে ‘বাধার কারণ হওয়ায়’ ক্ষোভ থেকে পালিত কন্যার হাতে পরিকল্পিভাবে মা ‘খুন’ হওয়ার একটি ঘটনা উদ্ঘাটনের দাবি করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। নগরীর পাহাড়তলীতে গত মঙ্গলবার রাতের মৃত্যুর এ ঘটনায় গত শুক্রবার কলেজপড়ুয়া মেয়েটিকে আটক দেখিয়েছে পুলিশ। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে শনিবার এ ঘটনার পেছনের কারণ তুলে ধরেন মামলাটির তদন্ত দলের নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) নিহাদ আদনান তাইয়ান।
এদিন তাকে আদালতে পাঠিয়েছে পাহাড়তলী থানা পুলিশ। পাহাড়তলীর দক্ষিণ কাট্টলী ছদু চৌধুরী রোডে মা আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে থাকত মেয়েটি। প্রবাসী বোন ও ছেলেদের আর্থিক সহায়তায় পালিত ওই কন্যাকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন তিনি। পুলিশ বলছে, মেয়েটি প্রমাণ করতে চেয়েছিল, রাতে চোর এসে তাদের মাকে আঘাত করায় গুরুতর জখম থেকে তার মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনায় আনোয়ারা বেগমের ছেলে আরিফুল হক মাসুম পাহাড়তলী থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি তার মাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করার কথা স্বীকার করায় শুক্রবার ওই মামলায় তাকে আটক দেখায় পুলিশ।
উপ-কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন,‘মেয়েটি যোগ ব্যয়াম, নাচ, মার্শাল আর্ট এসব শিখতে চাইত। টিউশনি করে নিয়মিত রাতে দেরি করে বাসায় ফিরত। আনোয়ারা বেগম এসব পছন্দ করতেন না। এসব বিষয় নিয়ে মায়ের সাথে অনেক দিন ধরে তার মনোমালিন্য চলছিল। এতে মেয়েটির মনে ধারণা জন্মে, মা থাকলে সে তার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে না। নিজের মত জীবনযাপন করতে পারবে না। তাই সপ্তাহখানেক আগে মাকে খুনের পরিকল্পনা করে’।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি বলেন, গত ২০ মে রাতে একটি কাঠের টুকরো দিয়ে মায়ের মাথায় আঘাত করে মেয়েটি। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পরদিন আনোয়ারা বেগমের মৃত্যু হয়। আনোয়ারা বেগমের মাথায় আঘাত করার সেই কাঠের টুকরোর সন্ধানে নেমে তার পালিত কন্যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তার কাথাবার্তায় অসংলগ্নতা পেয়ে অধিকতর তদন্তে নামে তারা। খবর বিডিনিউজের
মেয়েটি স্থানীয় একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আনোয়ারা বেগমের প্রথম স্বামীর ঘরে তিনটি ছেলে আছে। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে তিনি এই মেয়েকে দত্তক নেন। পরে আনোয়ারার দ্বিতীয় স্বামীও মারা যান।
পুলিশ কর্মকর্তা তাইয়ান বলছেন, ‘আনোয়ারা বেগমকে হত্যা করতে আগেই পরিকল্পনা করে নেয় মেয়েটি। নিয়মিত টিউশনি শেষে রাত ১১ টার দিকে বাসায় ফিরলেও ২০ মে ওই কিশোরী রাত ১০ টায় বাসায় ফেরে। ১০-১৫ মিনিট সে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। এরপর মায়ের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ঘরে থাকা একটি কাঠের টুকরা দিয়ে মাথায় বারবার আঘাত করে। এতে আনোয়ারা বেগম গুরুতর আহত হন। এসময় তিনি মাটিতে বসে পড়েন। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল’।
জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটির কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই অবস্থায় আনোয়ারা বেগমকে রেখে তার পালিত মেয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে। তারপর ঘরের দরজা খোলা রেখে বাইরে গিয়ে কাঠের টুকরাটি ফেলে দেয়। এরপর ওই কিশোরী আশেপাশের বাসিন্দাদের জানায়, চোর এসে তার মাকে মাথায় আঘাত করে গুরুতর জখম করে চলে গেছে। ঘরে এসে দরজা খোলা অবস্থায় এবং মাকে আহত অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। আনোয়ারা বেগমের ছেলেদেরও ফোনে একই কথা জানায় সে।
স্থানীয়দের সহায়তায় গুরুতর আহত আনোয়ারা বেগমকে শুরুতে পাহাড়তলী থানার ফইল্যাতলী বাজার এলাকার তাইসেফ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
চিকিৎসকরা আনোয়ারাকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন। চমেক হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি না থাকায় এশিয়ান স্পেশালাইজড অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করানো হয়। ২১ মে রাত সাড়ে ১০ টায় তিনি মারা যান।
পুলিশ কর্মকর্তা নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘শুরুতে মেয়েটি আমাদের বলেছিল চোর এসে আনোয়ারা বেগমকে কাঠের টুকরা দিয়ে মাথায় মেরে চলে গেছে। সে ঘরের মধ্যে কাঠের টুকরাটি দেখেছে। পরে যখন আমরা কাঠের টুকরোটি ঘরে খুঁজে পাইনি, তখন সন্দেহের সূত্রপাত হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। মেয়েটির মোবাইল ফোন ঘেঁটে মায়ের প্রতি তার রাগের কিছু সূত্র পাই’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও দেখে এবং কিছু বইপত্র পড়ে সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ওই কিশোরীর এক ধরনের বিরাগ জন্মে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা।
সন্দেহ হওয়ায় মেয়েটির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, একটি ছেলেকে সে পছন্দ করত। অবশ্য ছেলেটি তেমন কিছুই জানত না অর্থাৎ মেয়েটির একপক্ষীয় পছন্দ ছিল। ঘটনায় ব্যবহৃত কাঠের টুকরাটি ওই কিশোরীর দেখানো স্থান তাদের রান্না ঘরের পাশে একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।