৫৩ বছর ধরে ‘রশি টানা’ নৌকায় নদী পারাপার

5

মাসুদ নাসির, রাঙ্গুনিয়া

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১নং রাজানগর ও দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর উপর স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পরেও একটি সেতু নির্মিত না হওয়ায় যুগ যুগ ধরে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন দুই ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। বিশেষ করে একটি সেতুর অভাবে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাজানগর ইউনিয়নের শিয়ালবুক্ক এলাকার নদীবেষ্টিত ৩ গ্রামের ১০ হাজার মানুষ। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পরেও একটি সেতু নির্মিত না হওয়ায় এই ৩ গ্রামে পড়েনি উন্নয়নের প্রভাব।
দীর্ঘদিনের দাবির পরও ইছামতির নদীর ওপর সেতু না হওয়ায় দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে রশি টেনে নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হয় উপজেলার রাজানগর ও দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া, হরিণাছড়া, শিয়ালবুক্ক ও ফুলবাগিচাসহ আশেপাশের আরও ৮ গ্রামের ২০ হাজার মানুষকে। চরম দুর্ভাগ ও ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার করলেও এসব মানুষের কষ্ট যেনো দেখার কেউ নেই।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক ও চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের সংযোগ সড়ক হচ্ছে পারুয়া-রানীরহাট কালীন্দা রাণী সড়ক। উপজেলা ও জেলা শহরে যাতায়াতের একমাত্র পথ হচ্ছে এই সড়ক। এই কালীন্দা রাণী সড়কটি বয়ে গেছে রাজানগর ও দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের উপর দিয়ে। আর উক্ত ইউনিয়ন দু’টির উপর দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদী। নদীর পশ্চিম পাশে রয়েছে ৩টি গ্রাম, পূর্ব পাশে রয়েছে ৫টি গ্রাম। পশ্চিম পাশের ৩ গ্রামের তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ইছামতী নদী। অনেকটা দ্বীপের মতো। এই গ্রামের হাই স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী জীবনের ঝুঁঁঁকি নিয়ে প্রতিদিন রশি টানা নৌকা দিয়ে ইছামতী নদী পার হয়ে রাজাভ‚বন স্কুল, খন্ডলিয়া পাড়া মাদ্রাসা, আলমশাহ পাড়া কামিল মাদ্রাসা, উত্তর রাঙ্গুনিয়া হাই স্কুল, উত্তর রাঙ্গুনিয়া ডিগ্রি কলেজ, রাণীরহাট কলেজে যাতায়াত করেন।
এছাড়াও প্রতিদিন এপাশ-ওপাশের মানুষজন নিত্য কাজে শিয়ালবুক্ক ঘাট দিয়ে এই নদী পার হন। একই সাথে জেলা ও উপজেলা সদরে বিভিন্ন কাজসহ কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষাবাদ করা, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা নিতে যাতায়াত করে এখানকার হাজার হাজার মানুষ। সেতু না থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় পশ্চিম পাড়ের ৩ গ্রামের মানুষদের। বেশী ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিশু-নারী ও বৃদ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ রোগীদের। ঘাটে এসে তাদের অপেক্ষা করতে হয় পুরুষদের জন্য। এরপর রশি টেনে নৌকা নিয়ে নদী পার হতে হয়। বর্ষাকালে এ ভোগান্তি, দুর্দশা তীব্র আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয়; বর্ষা মৌসুমে এই নদী পার হওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। নদী পার হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকারও হতে হয় এসব গ্রামবাসীদেরকে। প্রায়শ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে বলে জানান এলাকাবাসী।
এদিকে একটি সেতুর অভাবে নদীর পশ্চিম পাড়ের ৩ গ্রামে অগ্নিকাÐ, অসুস্থ রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া বা কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরাও দ্রæত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দল পাল্টায়, সরকার যায়, সরকার আসে, এমপি যায় মন্ত্রী আসে। কিন্তু ইছামতী নদীর উপর একটা সেতু হয় না। অথচ ভোট এলে সব দলের নেতারাই সেতু নির্মাণের কথা দেন, কিন্তু কথা দিয়েও কেউ কথা রাখেননি। ইছামতী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ এখন এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি।
নাদিয়া শারমিন নামে রাজভ‚বন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানান, আমাদেরকে প্রতিদিনই রশি টেনে নৌকা নিয়ে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। অনেক সময় নৌকা না পেলে স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে হাঁটু পানি পার হতে হয়। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেই যাতায়াতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। একটা সেতু হলে আমাদের এই কষ্ট দূর হতো।
রাজাভ‚বন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের বলেন, একটি সেতুর অভাবে এই গ্রামের মানুষদের সারাবছর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে স্কুলের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য নৌকা পার হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অত্র গ্রামগুলোর মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে ব্রিজ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।
শিয়ালবুক্ক এলাকার বয়োবৃদ্ধ নজীর আহম্মদ বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ৫৩ বছরে কত সরকার এলো গেলো, কত এমপি গেলো মন্ত্রী এলো আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। দ্রুত ইছামতী নদীতে একটি সেতু নির্মাণের জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকৌশলী দিদারুল আলম বলেন, যেসব নদীতে সেতু নির্মাণ প্রয়োজন এমন তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারপরও আমি উক্ত স্থান পরিদর্শন করে প্রয়োজনবোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব পাঠাবো, যাতে অতি দ্রুত শিয়ালবুক্ক এলাকার ইছামতী নদীতে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।