২২ দিনের সংঘাতে নিহত অন্তত ৬৫০ : জাতিসংঘ

5

পূর্বদেশ ডেস্ক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতন আন্দোলন এবং তার পরবর্তী সহিংসতায় অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়-ইউএনএইচসিআর। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন-বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতা নিয়ে গতকাল শুক্রবার প্রকাশ করা প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি। খবর বিডিনিউজের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং আন্দোলনকারীদের তথ্য অনুযায়ী ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মধ্যে জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহে কয়েকশ মানুষের প্রাণহানির তথ্য আসে। আগস্টের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারবিরোধী থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ঢাকামুখী লং মার্চের মধ্যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এরপর বিভিন্ন থানা, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের বাড়ি, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। সরকারবিহীন সাংবিধানিক সংকটের চার দিনে বহু মানুষের মৃত্যুর খবর আসে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের দাবি তোলার কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্তের প্রস্তাব শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়েছিল জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর। ওই সময় এই বিশ্ব সংস্থা থেকে সহায়তা নেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও স্বাধীনভাবে তদন্তের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে সহিংসতার ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউএনএইচসিআর। আগামী সপ্তাহে প্রাথমিক তদন্তের জন্য একটি দল পাঠানোর আগে শুক্রবার প্রাথমিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করল ইউএনএইচসিআর।
নিহতদের মধ্যে প্রতিবাদকারী, পথচারী, খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থাকার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজার হাজার প্রতিবাদকারী ও পথচারী আহত হয়েছেন, রোগীদের ঢল নামায় হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে হিমশিম খায়। নিহতের এই সংখ্যা বাস্তবতা থেকে কম হতে পারে। কেননা, কারফিউয়ে চলাচল নিয়ন্ত্রণে থাকা, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে তথ্য সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। হাসপাতালগুলোকে নিহত ও আহতের বিস্তারিত তথ্য দিতে সরকারের দিক থেকে বাধা দেওয়ার খবরও প্রকাশ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার পতনের পর ৭ থেকে ১১ আগস্ট ‘প্রতিশোধমূলক হামলায়’ নিহতের সংখ্যা এখনও নির্ধারিত হয়নি, যার মধ্যে সহিংসতায় আহত হয়ে হাসপাতালে মৃতরাও রয়েছেন।
বেশিরভাগ হতাততের পেছনে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর তাজা গুলি ও অতিশক্তি প্রয়োগের কারণে এসব হতাহত হয়। বিপরীতে প্রতিবাদকারীরা বিক্ষুব্ধ থাকলেও সশস্ত্র ছিল না বা হালকা সশস্ত্র ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য ‘হুমকি’ না হওয়া স্বত্তে¡ও বিক্ষোভকারীদের ওপর ‘বেআইনিভাবে’ মারণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের উদাহরণ থাকার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। এ ক্ষেত্রে রংপুরে পুলিশের সামনে হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ‘গুলিতে’ নিহত হওয়ার এবং ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আহত একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টাকালে তার ওপর সাদা পোশাকে পুলিশের গুলি করার উদাহরণ টেনেছে জাতিসংঘ।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ওপর ‘প্রতিশোধমূলক’ আক্রমণের কথাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ আগস্ট উত্তেজিত জনতা লাঠি, লোহার রড ও পাইপ দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকদের ওপর হামলার খবর হয়েছে। সাংবাদিকদেরও আক্রমণ করা হয়েছে এবং ঘটনার ছবি-ভিডিও ধারণে বাধা দেওয়া হয়েছে।
সরকার পতন-পরবর্তী সব ঘটনার সঠিক তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহবান রেখে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম-নীতি মেনে শক্তি প্রয়োগের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাল্টা আক্রমণ ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা থেকে সংখ্যালঘুসহ জনসাধারণকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে তাদের।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, অন্তর্র্বর্তী সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য তিনটি গুচ্ছে সুপারিশমালা দিয়েছে জাতিসংঘ।
মানবাধিকার সামনে রেখে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা এবং আইনের শাসন ফেরাতে সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া অবলম্বনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ অন্তর্র্বর্তী সরকারকে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘ বলছে, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে ভেটিংয়ের পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করুন। বলপ্রয়োগ কমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট নির্দেশনা দিন, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নীতি মেনে চলে; বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার পবির্তনের প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিকসহ অন্যান্য সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহŸান রাখা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।