১২০ কি.মি. বেগে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’

11

পূর্বদেশ ডেস্ক

বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে উপক‚লে আঘাত হানে। গতকাল রোববার রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি মোংলার দক্ষিণ পশ্চিম দিক দিয়ে বাংলাদেশের খেপুপাড়া ও পশ্চিমবঙ্গ উপক‚লে আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে উপক‚লীয় এলাকায় ভারী বর্ষণের সঙ্গে বয়ে যায় তীব্র ঝড়ো হাওয়া। গতকাল রাতে আবহাওয়ার বিশেষ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান ড. শামিম হাসান ভূঁইয়া।
সুন্দরবনে দুই ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায় অতি প্রবল রেমাল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও। সুন্দরবনের দুবলা, কটকা, কোচিখালি ও হিরণ পয়েন্ট এলাকা গতকাল রাতে সাত থেকে ৮ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। দুবলা অস্থায়ী শুটকি পল্লীর কাঁচা ঘরসহ কয়েকটি বন অফিস ও টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অফিসের টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
সুন্দরবনের বিভিন্ন বন অফিস এলাকায় কর্মকর্তা ও বন্যপ্রাণিদের মিঠাপানির একমাত্র উৎস পুকুরগুলোও জলোচ্ছ¡াসের লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনের গাছপালারও ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। বাঘ হরিণসহ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড ম্যানগ্রোভ এই বনের বন্যপ্রাণিক‚লের ভাগ্যে কি ঘটেছে তার নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি কেউ।
সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কর্মকর্তা (এসিএফ) মাহবুব হাসান রাত ৯টায় জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘূর্ণিঝড় রেমাল সুন্দরবনের উপর আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যার আগেই বগিসহ সুন্দরবনে অবকাঠামো দুর্বল থাকা বন অফিস ও টহলফাঁড়ি থেকে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের নিরাপদের সরিয়ে আনায় তাদের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। সকাল না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতির কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তা নিশ্চিত করে জানানো সম্ভব নয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরা উপকূলে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে। প্রচন্ড বেগে বইয়ে যায় ঝোড়ো বাতাস। চলে টানা বৃষ্টি। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, আটুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী সাংবাদিকদের বলেন, সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড়। উপকূল প্লাবিত হয়েছে। প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের কিছু অংশ ধসে পানি ঢুকেছে আশপাশের গ্রামগুলোতে।
এর আগে সন্ধ্যা থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা, খোলপেটুয়া, মাংলঞ্চ, যমুনা নদী ও কপোতাক্ষ নদে স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, আটুলিয়া, কৈখালী, রমজাননগর, মুন্সিগঞ্জ উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি বৃষ্টির পাশাপাশি ঝোড়ো বাতাস বইছে। বাঁধ বেয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। উপকূলের বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন।
এদিকে, গতকাল সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লিখার সময় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণপশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। এটির কেন্দ্র আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে রাত ৩টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানায়। তবে ঝড়টি পুরোপুরি সরে যেতে এরপর আরও পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা লাগতে পারে।
রাত সোয়া ৯টার দিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দুইজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান। গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের অগ্রভাগ অতিক্রম করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি আগামী ১ থেকে ২ ঘণ্টার মধ্যে উপক‚ল অতিক্রম করবে। কেন্দ্রটি অতিক্রম করার পর ঘূর্ণিঝড়ের শেষ ভাগটি ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পর বাংলাদেশ অতিক্রম করবে। সব উপকূল এলাকায় বর্তমানে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকাগুলো ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ভেতরে ঢুকেছে। এই মুহূর্তে উপকূলীয় এলাকার মানুষজন বিপদের মধ্যে আছেন। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপপরিচালক মো. শামীম আহসান রাত সোয়া আটটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র আরও উত্তর দিকে সরে পরবর্তী ৫-৭ ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
শামীম আহসান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির পরিধি প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর অগ্রভাগ সন্ধ্যা ছয়টার দিকেই খুলনা উপক‚লীয় এলাকা হয়ে সুন্দরবনের দিকে প্রবেশ করে। ওই সময় থেকেই উপকূলে প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টিপাত শুরু হয়।
রাত সাড়ে আটটার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উপকূলের প্রতিটি জেলায় ঝোড়ো অথবা দমকা হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি শনিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় রেমালে পরিণত হয়। আজ (রোববার) সকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। ভোরেই পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী, খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলা এবং এসব জেলার কাছাকাছি দ্বীপ ও চরগুলোতেও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়।এছাড়া উপক‚লীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর ও চাঁদপুর জেলাসহ কাছের দ্বীপ ও চরগুলোতে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়।

৪০ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন : ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ এর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। গাছ পড়ে, লাইন ছিঁড়ে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো বিকল্প উপায়ে নেটওয়ার্ক চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) এক কর্মকর্তা জানান, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৪টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২৫ লাখ ৬৯ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎহীন এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পটুয়াখালী, বাগেরহাট, ভোলা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও ঝালকাঠি। পটুয়াখালীতে ৬ লাখ, বাগেরহাটে সাড়ে ৪ লাখ ও ভোলায় সোয়া ৪ লাখ, পিরোজপুরে ৩ লাখ, বরিশালে ১ লাখ ৮০ হাজার, সাতক্ষীরায় ১ লাখ ৭০ হাজার এবং ঝালকাঠিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। রাতে আরও ৮-১০ লাখ গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। দক্ষিণাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওজোপাডিকোরও ২-৩ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যথাসময়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি প্রয়োজনে বাতিল এবং অতিরিক্ত জনবল প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে ১৬৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হলে একটিকে ‘ঘূর্ণিঝড়’ বা ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলা হয়। গতিবেগ ৮৯ থেকে একশ’ ১৭ কিলোমিটার হলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়, গতিবেগ একশ’ ১৮ থেকে দুইশ’ ১৯ কিলোমিটার হলে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং গতিবেগ দুইশ’ ২০ কিলোমিটার বা তার বেশি হলে তাকে ‘সুপার সাইক্লোন’ বলা হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর নামকরণ করেছে ওমান। আরবিতে এর অর্থ বালি। এই নামে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে এক দশমিক সাত কিলোমিটার দূরে একটি শহরও রয়েছে।
এদিকে, দুর্যোগকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধ রাখার বিষয়ে স্ব স্ব জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গতকাল রবিবার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন এবং চলমান উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি ও মূল্যায়নবিষয়ক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রী বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় যেসব অবকাঠামো আছে, সেগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী অবস্থায় সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ীই হবে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের মে মাসে বাংলাদেশের উপক‚লে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। সুন্দরবনের কারণে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল দেশের উপকূল। এর আগে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসেই সুন্দরবনে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় আইলা।