হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি

24

পূর্বদেশ ডেস্ক

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই নিহত হয়েছেন বলে ইরানের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও হেলিকপ্টারে থাকা অন্য সকল যাত্রী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, ইরানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
গতকাল সোমবার সকালে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়, সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। পুরো হেলিকপ্টারটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
এর আগে, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার এলাকায় একটি ‘হিট সোর্স’ (উত্তপ্ত স্থান) শনাক্ত করেছিল তুরস্কের পাঠানো ড্রোন।
প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ মোখবার-এর নাম অনুমোদন করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি দুই মাস এ দায়িত্ব পালন করবেন। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে।
ইরানের কোনো প্রেসিডেন্ট অসুস্থতা, মৃত্যু, অভিশংসন বা সংসদ কর্তৃক অপসারণের ফলে দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হলে করণীয় কী, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির সংবিধানে। এতে বলা হয়েছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে মোহাম্মদ মোখবার) রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। একই সাথে সংসদ এবং বিচার বিভাগের প্রধানদের সাথে যৌথভাবে পরবর্তী সর্বােচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করবেন তিনি। এই সব কিছুই হতে হবে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন সাপেক্ষে। কারণ, ইরানের যেকোনো বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
রোববার আজারবাইজানের সীমান্তের কাছে দুটি বাঁধ উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এরপর হেলিকপ্টারে ইরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোল্লাহিয়ান ছাড়াও আরো ছিলেন ধর্মীয় নেতার (খামেনি) প্রতিনিধি ও তাবরিজের ইমাম সৈয়েদ মোহাম্মদ আল হাশেম, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালিক রাহমাতি, প্রেসিডেন্ট প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডার সরদার সৈয়েদ মেহদি মৌসভি, কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী এবং ক্রুরা।
তাবরিজ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হেলিকপ্টারটি। কিন্তু ভারী কুয়াশা থাকায় অনুসন্ধান অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্টের বহরে মোট তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করে।
পূর্ব আজারবাইজানের ডেপুটি গভর্নর ফর ডেভেলপমেন্ট আলি জাকারি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান ওই বহরে তিনটি হেলিকপ্টার ছিল এবং অন্য দুটি নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছে। একটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
নিরাপদে ফেরা হেলিকপ্টারে জ্বালানি মন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ান এবং আবাসন ও পরিবহনমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ ছিলেন।
ইরানের আধা সরকারি তাসনিম নিউজ এজেন্সি বলছে, হেলিকপ্টারের ভেতরে প্রেসিডেন্টের সাথে থাকা লোকজন জরুরি কল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্থানীয় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, হেলিকপ্টারের সাথে রেডিও যোগাযোগ করা হয়েছিল, তবে তিনি এর বাইরে আর কোনও ব্যাখ্যা দেননি।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানায়, প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বেল ২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার বহন করছিল। এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরে যুক্তরাষ্ট্রের এটি ইরানের কাছে বিক্রি করার কথা নয়। সে হিসেবে উড়োযানটি অন্তত ৪৫ বছরের পুরনো।
এর আগেও আকাশপথে দুর্ঘটনায় দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা ও বিভিন্ন সময়ে পরিবহনমন্ত্রী, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার বিমান বা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
ইব্রাহিম রাইসি একদিন আগে প্রতিবেশী আজারবাইজানে ছিলেন। তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সাথে বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন।
৬৩ বছর বয়সী রাইসি ২০২১ সালে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশটির মরালিটি বা নৈতিকতা বিষয়ক আইন কঠোর করার নির্দেশ দেন। তাকে একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে তিনি সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখেও পড়েছেন।
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সাথে পারমাণবিক আলোচনায় তিনি কঠোর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকে মনে করেন তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা তাকে বিচার বিভাগের প্রধানের শক্তিশালী পদে নিযুক্ত করেন।
রাইসি বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন। ইরানে ৮৮-সদস্যের এই বোর্ড দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে।

আজ রাইসির দাফন : এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির দাফন আজ মঙ্গলবার তাবরিজে অনুষ্ঠিত হবে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানিয়েছে। ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃৃত করে তাসনিম আরো জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তার নিহত সফরসঙ্গীদের দাফনও হবে সেখানে। তার আগে, মরদেহগুলো তাবরিজের ফরেনসিক বিভাগে রাখা হবে।
এদিকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি জানিয়েছেন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবারকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পাঁচ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি।
অন্যদিকে ইরানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আলি বাঘেরি কানি। নির্বাহী, সংসদ ও বিচার, সরকারের তিন বিভাগের এক বৈঠকের পর ঘোষণাটি আসে।

রাইসির মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া : ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতের ঘটনায় ইরানজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। জনগণকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ইরানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। শোক জানিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ অন্যান্য দেশ।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি একজন অসাধারণ রাজনীতিক ছিলেন যার পুরো জীবন মাতৃভ‚মির সেবায় নিয়োজিত ছিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তায়িপ এরদোয়ান বলেন, আমি জনাব রাইসিকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। যিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ইরানি জনগণ ও আমাদের অঞ্চলে শান্তির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন। গতকাল এক্সে পোস্টে মি. মোদি লিখেছেন, তার পরিবার ও ইরানের জনগণের প্রতি আমার সমবেদনা জানাচ্ছি। এই শোকের সময়ে ভারত ইরানের পাশে আছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেন, রাইসি’র মৃত্যুতে অনেক বড় ক্ষতি হলো। পাকিস্তানে একদিনের শোক ঘোষণার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো রাইসির প্রশংসা করে বলেন, তিনি ছিলেন একজন অকৃত্রিম বন্ধু এবং অসাধারণ নেতা।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তা আল-সিসি বলেন, আরব প্রজাতন্ত্র মিশরের প্রেসিডেন্ট ভ্রাতৃসম ইরানি জনগণের প্রতি তার আন্তরিক সমবেদনা ও সহানুভ‚তি প্রকাশ করছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, গত নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সম্মান পেয়েছিলাম। তিনি তার জনগণের কল্যাণ ও জাতির মর্যাদার প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতির উদাহরণ রেখেছিলেন।
লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এক বিবৃতিতে ইরানি জাতিকে রক্ষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের সংগ্রাম ও ইরানের প্রতি তাদের সেবার প্রশংসা করেছে।
এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাখতুম, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল, জাপান সরকার, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস, ইয়েমেনের হুতি প্রধান মোহাম্মদ আলি আল হুতি, কাতারের আমির শেখ তামিন বিন হামাদ আল-থানি ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির শোচনীয় মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন।