হাট-বাজার ইজারায় তিন বছরে গচ্ছা ৫ কোটি টাকা

18

ওয়াসিম আহমেদ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হাট-বাজার ইজারায় বছরান্তে কমপক্ষে ৬ শতাংশ বাড়ানোর নিয়ম রয়েছে। সে হিসেবে গত ৩ অর্থবছরে হাট-বাজার ইজারা থেকে ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে চসিক। সে ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও অন্তত ৪ কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর পথে সংস্থাটি। সিন্ডিকেট করে দরপত্র প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও অসাধু কর্তাদের যোগসাজশে এমনটা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চসিকের বাজেট বই সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে হাট-বাজার ও খেয়াঘাট ইজারা থেকে চসিকের আয় ছিলো ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে একই খাতে আয় ৫০ লাখ টাকা কমে দাঁড়ায় ১৮ কোটিতে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হাট-বাজার ইজারা থেকে আয় ৩ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। অথচ বছরান্তে ন্যূনতম ৬ শতাংশ ইজারা দর বাড়লে গেল অর্থ বছরে আয় হওয়ার কথা প্রায় ২০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত ৩ বছরে ৫ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারিয়েছে সংস্থাটি।
নিজস্ব আয়ের উপর চলা সেবা সংস্থা চসিকের আয়ের খাত হাট-বাজার ইজারায় যেন ধস নেমেছে। ৩ দফা দরপত্র আহŸান করেও মেলেনি কাঙ্খিত দরের ইজারাদার। ‘সিন্ডিকেট’ করে বাজারদর কমাতেই এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এর মধ্যে এক ইজারাদার থেকে পে-অর্ডার জমা নিয়ে আবারও দরপত্র আহŸান করায় সাগরিকা গরুর বাজারের দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। সবকিছুর দর উর্ধ্বমুখী হলেও চসিকের পশুর হাটের ইজারা দর নিম্নমুখী। স্থায়ী বাজার ইজারা নিয়ে এমন বেহাল দশার মধ্যে আরও ৭টি অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারার দরপত্র আহবান করেছে চসিক। গেল বছর এসব অস্থায়ী বাজারের ইজারা দরও কমেছে।
জানা গেছে, চসিকের দুইটি বড় ও একটি ছোট স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে। বড় দুই বাজার হলো বিবিরহাট গরুর বাজার এবং সাগরিকা গরুর বাজার। এই ২ বাজার থেকে করোনা মহামারীর বছর ২০২০ সালে চসিক আয় করেছে ৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। নিয়মানুযায়ী আগের বছরের তুলনায় ন্যূনতম ৬ শতাংশ দর বাড়ার কথা। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে উল্টো পথে চসিকের এই দুই স্থায়ী বাজারের ইজারা দর।
মূলত দরপত্র আহবানের পরই সিন্ডিকেট করে ইজারাদারেরা দরপত্রে অংশ নেয় না। নিলেও তুলনামূলক কম দর দিয়ে ‘টেন্ডার ড্রপ’ করে। ফলে চসিক অনেকটা বাধ্য হয়ে কম দর দিয়ে ইজারা দিয়ে দেয়। এ চক্রের সাথে চসিকের রাজস্ব বিভাগের বেশ কিছু অসাধু কর্তা জড়িত বলে জানা গেছে।
২০২০ সালে বিবিরহাট গরুর বাজারের ইজারা হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকায়। পরের বছরও ঠিকঠাক ছিলো। ২০২২ সালে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকায় বাজারটি ইজারা হয়। ২০২৩ সালের শুরুতে মুরাদপুরে রাস্তা ও ব্রিজের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। ফলে ছয় মাস রাস্তা বন্ধ থাকে। এ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে বিবিরহাট গরুর বাজার নিয়ন্ত্রণে নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র। ৬ শতাংশ বাড়লে বাজারটির ন্যূনতম দর হওয়ার কথা ছিলো ২ কোটি ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭৭ টাকা। ইজারাদার নিয়োগ না হওয়ায় বাজারটি থেকে খাস সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় চসিক। দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলীকে। তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বাজার ব্যবস্থাপনার সবকিছু। ফলে নামমাত্র খাস কালেকশন করে চসিক। যা টাকার অংকে মাত্র ৫০ লাখ টাকা। যা ন্যূনতম কাঙ্খিত ইজারা দর থেকে ১ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ টাকা কম। এ পরিমাণ রাজস্ব চসিক হারিয়েছে। গত বছর রাস্তা বন্ধ থাকলেও এ বছর সব ঠিকঠাক। কিন্তু আগের বছরের মতো এ বছরও বিবিরহাট গরুর বাজারের জন্য ইজারা দর পায়নি চসিক। ফলে খাস কালেকশনের নামে এবারে বাণিজ্য করার পাঁয়তারা করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
চসিকের সবচেয়ে বড় পশুর হাট সাগরিকা গরুর বাজার। ২০২০ সালে বাজারটি ইজারা হয় ৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকায়। ২০২২ সালে হয় ৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। নিয়ম অনুসারে এ বছন ন্যূনতম দর হওয়ার কথা ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু একজন ইজারাদার থেকে ৬ কোটি টাকা দর ধরে পে-অর্ডার নিয়েছে চসিক। পে-অর্ডার নেওয়ার পর টেন্ডার আহবান করায় ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। ব্যারিস্টার কাজী আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়-আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিন্নাত হক গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ ১৩ মে প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির মধ্যে সাগরিকা গরু বাজারের কার্যক্রম ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। চিঠিটি গত মঙ্গলবার চসিকের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, দ্বিতীয় দফায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ইজারাদার না পেয়ে সাগরিকা গরু বাজার পরিচালনার জন্য ‘মিরা মেরিন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রোপ্রাইটর মো. ফজলে আলিম চৌধুরীর কাছ থেকে ৭টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা নেয় চসিক। তৃতীয় বারের বিজ্ঞপ্তিতে এই বাজারটি অন্তর্ভুক্ত করায় ১৯ মে ভুক্তভোগীরা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন।
হাট-বাজার ইজারা থেকে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আগে কুরবানি ঈদের বাজার জমজমাট হতো। তখন এগ্রো ফার্ম ছিলো না। মানুষ বাজার থেকে কুরবানি পশু কিনতো। এখন বেশিরভাগ মানুষ এগ্রো ফার্ম বা অনলাইন থেকে গরু কিনে রাখে। তাছাড়া অলি-গলিতে বাজার বসে যায়। যার কারণে কুরবানি পশুর বাজারগুলো আবেদন হারিয়েছে। তাই ইজারাদারেরা দর বাড়াতে চায় না।’