হাটহাজারীতে গোলাগুলি-সংঘর্ষ গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৬

21

হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি প্রতিনিধি

উপজেলার পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় গতকাল হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়াসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উপজেলায় ভোট গ্রহণ হয়। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলে। এ সময় হাটহাজারীতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, ক্যাম্প ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে ফটিকছড়িতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে ভোটগ্রহণ। তবে কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, হাটহাজারীতে ফতেপুর জোবরা গ্রামে কেন্দ্র দখল নিতে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, ক্যাম্প ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি কেন্দ্রে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ভোটকেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং কেন্দ্রে আগত নারী ও পুরুষ ভোটারদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রেগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। তবে উপজেলা নির্বাচনী অফিস সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে শতকরা ২৫.২৬ ভাগ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
সরেজমিন এবং প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে ১০৬টি কেন্দ্রের ৯শ ৭৩টি বুথে সকাল ৮টা বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। দুপুর ১২টার দিকে জোবরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোবরা পিপি স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোটরসাইকেল প্রতীকের এসএম রাশেদুল আলম ও ঘোড়া প্রতীকের সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমানের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত গিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।
এ ঘটনার আধঘণ্টা যেতে না যেতে দুপুর ১টার দিকে রাশেদুল আলমের সমর্থকরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দুই নম্বর সড়কের রেলগেটে জড়ো হন। তারা আতঙ্ক ছড়াতে দুই দফা ৮-১০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এ সময় ভোটকেন্দ্রে আগত দুই ভোটার গুলিবিদ্ধ হন। তারা হলেন স্থানীয় প্রবাসী মো. করিম (৩০) ও মো. আরিফ (২৪)।
এ সময় ঘোড়া প্রতীকের সমর্থকদের ভোটার স্লিপ প্রদানকারী ক্যাম্প ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। পরে ওই ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে এবং বেশ কিছু নারী ও পুরুষ ভোটারের উপর চড়াও হয়ে তাদেরকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ করে স্থানীয় মো. বাসেক।
তিনি জানান, মোটরসাইকেল সমর্থকদের হামলায় প্রায় ১২ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ফরিদ আহমেদ (৬০), শাহাবুদ্দিন (৪৫), মো. হাসেম (৪০), মো. মামুন (৩৬), আসিফ আকবর (৩৬) ও শিরু আক্তারের (২৪) নাম জানা গেছে। গুলিবিদ্ধ দুইজন ও আহত কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
ঘটনার খবর পেয়ে জোবরা এলাকায় র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন বলে জানান হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেল প্রতীকের সমর্থকরা ঘোড়া প্রতীকের সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়। তারা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আমারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেজন্য কেন্দ্রের বাইরে এবং ভেতরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কেন্দ্র বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলির বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এর কারণ জানাতে পারেনি জোবরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সহকারী কৃষি প্রকৌশলী মো. ফরিদ উজ জামান। তিনি জানান, কেন্দ্রের ভিতরে কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি। বাইরে যখন বিশৃঙ্খলা হচ্ছিল, তখন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ অব্যাহত ছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার পর দুই কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমে যায়।
এছাড়া মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহতারা হলেন ইমতিয়াজুল আলম (৩৩) ও জসিম শিকদার (৫০)। দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মধ্য মাদার্শা নবাবীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে ধলই ইউনিয়নের পশ্চিম ধলই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঘোড়া প্রতীকের এজেন্ট মো. হারুনের স্ত্রী শানু বেগমের (৪০) ভোট অন্যজন প্রয়োগ করেছে বলে অভিযোগ করেছে। বিষয়টি স্বীকার করে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ফতেয়াবাদ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ওই ভোটার (শানু বেগম) চাইলে টেন্ডার ভোট দিতে পারবেন।
ভোটগ্রহণকালে গুমানমর্দ্দনের বেশকিছু কেন্দ্র ও দক্ষিণ মাদার্শা আকবরিয়া স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ করেন বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকরা। পাশাপাশি জাল ভোট প্রদানের চেষ্টার অভিযোগে উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মো. রায়হান (২২) নামে এক ভুয়া ভোটারকে আটক করে পুলিশ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, দুই-একটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
অন্যদিকে ফটিকছড়িতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে ভোটগ্রহণ। ব্যালেট পেপারের মাধ্যমে ভোট প্রদান করেন ভোটাররা। ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারের ছেয়ে পুরুষ ভোটার বেশি হলেও ভোটারের উপস্থিত ছিল কম। তবে কয়েকটি কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান গতকাল দুপুরে ফটিকছড়ি সরকারি কলেজে ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি দেখতে আসেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবেই ভোট শেষ হয়েছে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরমের কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। তবে প্রথম ধাপের নির্বাচন থেকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি।
জানা গেছে, ২টি পৌরসভা ও ১৮ ইউনিয়নের ১৪২টি কেন্দ্রে ৭শ ৭৬টি স্থায়ী এবং ২শ ১৬টি অস্থায়ী বুথে ভোট গ্রহণ করা হয়। উপজেলাজুড়ে ১ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ২৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৬ প্লাটুন বিজিবি, ২০ জন র‌্যাব, ৭ শ ৬৯ জন পুলিশ, ২ হাজার ৩৬ জন আনসার, ১০ জন ব্যাটেলিয়ন আনসার সদস্য নিয়োজিত ছিলেন।
উপজেলার রোসাংগিরী ইউনিয়নের আজিমনগর আহমদিয়া রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, নানুপুর ইউনিয়নের মজাহারুল উলুম গাউছিয়া ফাযিল মাদ্রাসা কেন্দ্র, নানুপুর আবু সোবাহান উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, জাফাতনগর ইউনিয়নে লতিফ রহমান উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, বক্তপুর ইউনিয়নে বক্তপুর দায়রাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, ধর্মপুর ইউনিয়নে উত্তর ধর্মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, নাজিরহাট পৌরসভায় নাজিরহাট জামিয়া মিল্লিয়া আহমদিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র, ফটিকছড়ি পৌরসভায় ফটিকছড়ি সরকারি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্র, সুন্দরপুর ইউনিয়নে আজিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, ভূজপুর ইউনিয়নে ভূজপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নে হারুয়ালছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র ও দাঁতমারা ইউনিয়নে হেঁয়াকো বনানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ একাধিক কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, সকাল ৮টায় ভোট শুরু হলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটার বাড়তে থাকে। বেশ উৎসাহ নিয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন। তবে কেন্দ্রে নারী ভোটারের ছেয়ে পুরুষ ভোটার বেশি হলেও ভোটারের উপস্থিত ছিল কম। প্রায় কেন্দ্রে নবিন ভোটারদের লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে নাজিরহাট পৌরসভাধীন সুয়াবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাহিরে ১২ টার দিকে, সমিতিরহাট ইউনিয়নে সমিতিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র বিকেল ৩টার দিকে, নানুপুর ইউনিয়নের মজাহারুল উলুম গাউছিয়া ফাযিল মাদ্রাসা কেন্দ্র দুপুরে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী নাজিম উদ্দীন মুহুরী ও আনারস প্রতীকের প্রার্থী বখতিয়ার সাইদ ইরানের সর্মথকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ওসব এলাকায় উত্তেজন সৃষ্টি হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন। এসব ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ সময় সবাইকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ জানান সমিতিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ ইমন। তিনি দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান। তাছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ছিল লক্ষণীয়।
জীবনের প্রথমবার ভোট দিতে পেরে নবীন ভোটারগণ খুবই খুশি বলে জানান। নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন মাঠে ভোট যুদ্ধে থাকা ৮ প্রার্থী। তারা হলেন চেয়ারম্যান পদে ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন মুহুরী (মোটরসাইকেল), উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বখতেয়ার সাঈদ ইরান (আনারস), ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ছালামত উল্লাহ চৌধুরী (বই), সাংবাদিক সৈয়দ জাহেদউল্লাহ কুরাইশী (তালা), ফটিকছড়ি পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন (টিউবওয়েল), মো. নাজিম উদ্দীন সিদ্দিকী (চশমা), নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেবুন নাহার মুক্তা (প্রজাপতি), মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী শারমীন আকতার নুপুর (ফুটবল)।
ফটিকছড়ি সংসদীয় আসনের এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার সনি সকালে নানুপুর ইউনিয়নের মজাহারুল উলুম গাউছিয়া ফাযিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এবং চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম কিপাইত নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রদান করেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশ উৎসাহ নিয়ে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। ভোট চলাকালীন কোথাও কোন বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে ছিল।