হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

13

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনৈতিক ক্ষমতার নজিরবিহীন অপব্যবহার করে দেশের অন্যতম শীর্ষ জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি গ্রুপকে ধ্বংস করে দিয়েছে হাছান মাহমুদগণ। এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রধান হাতিয়ার বানিয়ে গত ৬ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগও বন্ধ করে দেয়। এ কারণে ১৫শ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি দেশ-বিদেশে ভাবমূর্তি গভীর সংকটে পড়ে। শুধু তাই নয়, মামলা-হামলা এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানকে সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমন সময়ে এফএমসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার কোটি টাকার ডকইয়ার্ড হাতিয়ে নিতে চেয়ারম্যান ইয়াছিন চৌধুরীর সঙ্গে ‘মোসাদ’ ও নুরুল হক নুরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালায়। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকা ইয়াছিন চৌধুরী প্রকাশ্যে এসে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করলে এসব তথ্য উঠে আসে।
হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা : এফএমসি ডকইয়ার্ড অফিসে হামলা এবং জোর করে স্ট্যাম্পে সই নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রী, দুই ভাই ও ব্যক্তিগত সহকারীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলাটি দায়ের করেন প্রতিষ্ঠানটির হেড ক্লার্ক ফিরোজ আহমদ।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ড. হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরেন ফাতেমা, এরপর আসামি হিসেবে ড. হাছান মাহমুদ, তার দুই ভাই খালেদ মাহমুদ, এরশাদ মাহমুদ এবং ব্যক্তিগত সহকারি ইমরুল করিম রাশেদ, দি বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস এর জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ নুর উদ্দিন ও হিসাব বিভাগ প্রধান এরাদুল হকের নাম রয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরেন ফাতেমার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দি বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসের সঙ্গে এফএমসি ডকইয়ার্ডের দুটি কন্টেইনার ও ফিশিং জাহাজ নির্মাণের চুক্তি হয়। কিন্তু অবৈধ বল প্রয়োগ করে টাকা না দিয়ে এফএমসি প্রতিষ্ঠান থেকে জোরপূর্বক একটি ফিশিং জাহাজ ডেলিভারি নেয় তারা। অন্য একটি কন্টেইনার জাহাজের ব্যয় প্রদান না করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ডেলিভারি দিতে চাপ প্রয়োগ করে। এই নিয়ে এফএমসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আসামিদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৭ মার্চ হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নুরেন ফাতেমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে বাকি আসামিরা সন্ত্রাসীদের নিয়ে এফএমএসি ডকইয়ার্ডের নিরাপত্তারক্ষী ও অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মারধর করেন। এরপর এফএমসির চেয়ারম্যান ইয়াছিন চৌধুরীকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক অলিখিত স্ট্যাম্প ও এফএমসি ডকইয়ার্ডের অলিখিত লেটার প্যাডে স্বাক্ষর নেন তারা।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মঙ্গলবার রাতে থানায় মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে।
৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ : সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান। গত রবিবার (২৫ আগস্ট) হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী নুরেন ফাতেমা বরাবর এ সংক্রান্ত আইনি নোটিশ পাঠিয়ে এই ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জিয়ান মাহমুদ ক্লিনটন ইয়াছিন চৌধুরীর পক্ষে এই নোটিশ পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, নুরেন ফাতেমা দি বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা অন্যায়, নির্যাতন এবং মানসিক ও প্রশাসনিক হয়রানির মাধ্যমে এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও তাঁর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে।
নোটিশে ক্ষতিপূরণের ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করা না হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলাসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া হয় শতকোটি টাকা ঋণের বোঝা : ২০১২ সালে অক্টোবরে একটি কন্টেইনার ভেসেল নির্মাণের জন্য এফএমসি ডকইয়ার্ডের সঙ্গে বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসের চুক্তি হয়। এর নির্মাণ মূল্য ধরা হয় ৪৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিস সাড়ে ২৪ কোটি টাকা দেয়। বাকি সাড়ে ২৪ কোটি পাওনা থাকে। একই সময় ১৮ কোটি ৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি ফিশিং ট্রলার নির্মাণের চুক্তি করা হয়। চুক্তি মূল্য অনুযায়ী গ্রহীতারা ১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা বকেয়া থাকে। টাকা পাওনা থাকার পরও এফএমসি ডকইয়ার্ড নিজস্ব উৎস থেকে টাকা বিনিয়োগ করে উভয় জাহাজ নির্মাণকাজ সম্পাদন করেছিল। এসব পাওনা টাকা বহু বছর পরিশোধ না করায় গত ১০ বছর প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব বিনিয়োগের বর্তমানে সুদ ও বিজনেস অপরচুনিটি কস্টসহ ৮০ কোটি টাকার অধিক হয়েছে। যা এফএমসি ডকইয়ার্ড বহন করছে।
এছাড়া জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংকের দিলকুশা শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ৬৮ কোটি টাকা ঋণের বোঝা এফএমসি’র উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এমনকি এ ঋণের বিপরীতে হাছান মাহমুদের জাহাজ বন্ধকীতে ছিল। কিন্তু তা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ইয়ার্ড থেকে জাহাজ নিয়ে যাওয়া হয়।
৬ বছর ধরে এফএমসি’র বিনিয়োগ বন্ধ : ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড। সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ২০০টি নতুন জাহাজ তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পুরোদমে চালু ছিল। এরপর হাছান মাহমুদগণের রাজনৈতিক দাপটের কারণে গত ৬ বছরে ১৫ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পেন্ডিং রয়েছে অনেক ওয়ার্ক অর্ডার। ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে না পারায় বাতিলও হয়েছে ওয়ার্ক অর্ডার। এমনকি এই সময়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বিআইডবিøউটিএ, বিআইডবিøউটিসি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাছান মাহমুদ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের সব কর্মকাÐে বাধা সৃষ্টি করায় বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের বিনিয়োগ।
যেভাবে এফএমসি’র মালিককে সপরিবারে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় : ২০২১ সালের ৭ মার্চ, সময় দুপুর দুইটা এক মিনিট, স্পট- এফএমসি ডকইয়ার্ডের নগরীর হিলভিউ এক নম্বর রোডের করপোরেট অফিস। চলছে করোনাকাল। সব ধরনের অফিসে স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ। এমন সময় ভবনের গেটে আসেন হাছান মাহমুদের ছোট ভাই খালেদ মাহমুদ সহ বেশ কয়েকজন। অফিসের মূল ফটকে কড়া নাড়েন তিনি। এগিয়ে যান নিরাপত্তা কর্মী, সালাম দিয়ে জানতে চান, ‘স্যার কোথায় যাবেন’। এটা জিজ্ঞেস করায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন খালেদ। অনেকটা সজোরে ধাক্কা মেরে ঢুকে পড়েন ভেতরে। ঢুকেই নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর। নিজে ইচ্ছেমতো মেরে ক্লান্ত হওয়ার পর এগিয়ে যায় তার সহযোগী। দু’জনে মেরে নিরাপত্তা কর্মীকে মারাত্মক আহত করে। আশপাশে থাকা কেউ এগিয়ে যেতে সাহস করেনি। সবাই ছিল নীরব দর্শক। এক মিনিট ১৩ সেকেন্ডের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে নির্মম এই ঘটনা। এফএমসি ডকইয়ার্ডে অয়েল ট্যাংকার, ফিশিং ট্রলার বানিয়ে টাকা বকেয়া রেখে অন্যত্র বিক্রি করে আবার অর্ডার নিতে বাধ্য করে কন্টেইনার শিপের। কন্টেইনার শিপের ৭০ ভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর জোর করে ব্যাংকের শত কোটি টাকার ঋণের বোঝা তুলে দেয় প্রভাব খাটিয়ে। আবার বিশাল অংকের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে করা হয় মামলা। আরও নানা কায়দায় মামলা দিয়ে এফএমসির মালিক ইয়াছিন চৌধুরীকে সপরিবারে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতেও হুমকি পাঠায়। এমন সুযোগে এফএমসি থেকে লুট করে নিয়ে যায় কন্টেইনার শিপটি। সার্টিফিকেটবিহীন জাহাজটিও অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

ডকইয়ার্ড হাতিয়ে নিতে মোসাদ-নুরু ফাঁদ : চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদÐিতে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ৬৫ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড। অত্যাধুনিক এলটিসি ভ্যাসেল, টিসিভি ভ্যাসেল, অত্যাধুনিক মাল্টিপারপাস ভ্যাসেল, ব্যারাক বার্জ, সার্ভে ভ্যাসেল, কন্টেইনার শিপ, অয়েল ট্যাংকার, যাত্রীবাহী জাহাজ, ফিশিং ট্রলার, ড্রেজার নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এফএমসি গ্রæপের সবকিছু শেষ করে দিয়ে সর্বশেষ ডকইয়ার্ডটি হাতিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইয়াছিনের বিরুদ্ধে বিদেশে অবস্থান নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মদদ ও অর্থের জোগান দিচ্ছেন বলে প্রচারণা চালায় আসামিরা। এমনকি তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ‘মোসাদ’ ও নুরুল হক নুরের সঙ্গে ইয়াছিনের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি তোলে আসামিরা।
এফএমসি গ্রæপের চেয়ারম্যান ইয়াছিন চৌধুরী জানান, ‘রাজনৈকিক প্রভাব খাটিয়ে হাছান মাহমুদগণ আমার স্বপ্নযাত্রাকে তছনছ করে দিয়েছে। এ কারণে আমার প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ৬ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। এসময় আমি ১৫শ কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছি। অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ঋণের বোঝা। এমনকি আমাকে সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে তারা। সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতা না পেলে পুনরায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’