হজের হুকুম আহকাম

27

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

ইতিপূর্বে হজের ফজিল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হজ সঠিক ভাবে পালন করতে হলে হজের বিধি বিধান, হুকুম আহকাম সম্পর্কে জানতে হবে। হজ যেহেতু জীবনে একবার ফরজ তাই আহকাম সম্পর্কে মানুষের সারা জীবন সচেতন করতে হয় না। কিন্তু যারা হজে গমন করবে তাঁদের জানতে হবে মাসালা মাসায়েন। যে কাজ করবে সে কাজটির আগে বিধান জানা কর্তব্য।
হজ তিন প্রকার (১) হজে ইফরাদ : শুধুমাত্র হজ সম্পাদনের লক্ষ্যেই ইহরাম পরিধান করে তালবিয়া পাঠ করাকে ‘হজ ইফরাদ’ বলে। (২) হজে তামাত্তু : হজের মাসে প্রথম ওমরা আদায় করে হালাক হয়ে ঘরে ফিরে আবার হজের ইহরাম পরিধান করে হজ আদায় করাকে ‘হজে তামাত্তু’ বলে। (৩) হজে কিরান : একই সাথে হজ ও ওমরা পালনের নিয়মে ইহরাম পরিধান করাকে ‘হজে কিরান’ বলে। এই তিন প্রকার হজ আদায় করা জায়েজ আছে। ফতোয়ায়ে শামী গ্রন্থে বর্ণনা আছে ঈমাম আবু হানিফা (রাহ.)’র মাজহাব মতে ‘হজে কিয়ান’ সবচেয়ে উত্তম। তারপর ‘হজে তামাত্তু’ তার পর ‘হজে ইফরাদ’-এর অবস্থান।
হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য ইহরাম পরিধান করা ফরজ। ‘ইহরাম’ আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ করা। হজ ও ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে কোন মুসলমান যখন ইহরাম পরিধান করে তখন তার উপর কিছু হালাল কাজ হারাম হয়ে যায় বলে তাকে ইহরাম বলে। সাধারণ অর্থে আমরা হজ পালনরত অবস্থায় দু’টি পরিধানের চাদরকে ইহরাম বলি।
যে স্থান হতে ইহরাম বাঁধতে হয় সে স্থানকে বলা হয় মীকাত। ইহরাম পরিধান অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ তাতে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে মীকাতের পূর্বে নিজ ঘর হতে ইহরাম বাঁধা উত্তম। তা না হলে মীকাত হতে ইহরাম বাঁধা ভালো। বাংলাদেশি হাজীদের জন্য মীকাতের স্থানের নাম ইয়ালামলাম। যারা বিমানযোগে হজ করবেন এবং মক্কা শরীফ পৌঁছাবেন তাঁরা যেন বিমানে আরোহনের পূর্বেই ইহরাম পরিধান করেন। কারণ ইয়ালামলাম স্থানটি বিমানে অতিক্রম হয়ে যায়। আর যারা হজ আদায়ের পূর্বে মদিনা শরীফ গমন করবেন তাঁরা ইহরাম ছাড়া মদিনায় গমন করবেন। অতঃপর মদিনার জিয়ারত শেষে যখন হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করবেন তখন মসজিদে জুল হুলাইফা হতে ইহরাম পরিধান করবেন। বিমানেও ইহরাম পরিধান করা জায়েজ কিন্তু মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই পরিধান করতে হবে।
মীকাতের বাইরে বসবাসকারী কোন সুস্থ, প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান মক্কা বা হেরেম শরীফে প্রবেশ করতে চায়; সে হজ ও ওমরার উদ্দেশ্যে হোক বা অন্যকোন কাজে হোক, যদি ইহরাম বাঁধা ছাড়া মীকাত অতিক্রম করে তাহলে গুনাহগার হবে। সে ব্যক্তি মীকাতে ফিরে আসা ওয়াজিব। যদি মীকাতে ফিরে না আসে সেখানেই ইহরাম বেঁধে তাহলে তাঁর উপর দমন (পশু কোরবানী)ওয়াজিব। মীকাতে ফিরে গিয়ে ইহরাম বাঁধলে দম দিতে হবে না। আর যদি বিনা ইহরামে মক্কায় বা হেরেম হেরেমে প্রবেশ করে তাহলে তাঁর উপর হজ অথবা একটি ওমরা ওয়াজিব হভে। (আলমগীরী ১ম খন্ড)
ইহরাম পরিধান করার পূর্বে শারীরিক পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। হাত ও পায়ের নক কেটে, গোঁফ কেটে মাথায় চুল ছোট কালের পশম ও নাভীর নিচে পরিষ্কার করতে হয়। ইহরামের পূর্বে গোসল করা উত্তম সম্ভব না হলে ওজু করে নেওয়া জরুরী। সেলাইবিহীন দুটি কাপড়, একটি লঙ্গি অন্যটি চাদর হিসেবে ব্যবহার করবে। সুগন্ধী বা আতর ব্যবহার করতে পারেন অতঃপর মাথায় টুপি পরিধান করে দুই রাকাত সুলাতুল ইহরাম (ইহরামের নামাজ) আদায় করবে। প্রথম রাকাতে সূরা, কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখিলাস পড়া উত্তম। নামাজ শেষে বসা অবস্থায় টুপি খুলে হজ বা ওমরার নিয়ত করতে হয়। নিয়ত করার ফরজ কিন্তু পড়া ফরজ নয়। নিয়ত না করলে ইহরাম সহীহ হবে না। নিয়ত ছাড়া তালবিয়া পাঠ করলে ইহরাম সহীহ হবে না। ইহরামের জন্য নিয়ত ও তালবিয়া উভয়টিই জরুরি (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)
হজ বা ওমরা সম্পাদন না করে ইহরাম খোলা যাবে না। যদি ইহরাম ভেঙ্গে যায় তবুও ইহরাম অবস্থাতেই বহাল থেকে হজ ও ওমরার বাকী কাজ সম্পাদন করতে হবে।
কোন ব্যক্তি যদি ইহরাম বাঁধার পরে কোন কারণে হজ পালন করতে না পারে তবে ওমরা পালন করে হালাল হবে। কেউ যদি ইহরাম বাঁধার পর হজ পালনে বাধাগ্রস্ত হয় তখন হেরেম এলাকায় কোরবানীর পশু প্রেরণ করতে হবে এবং সেখানে কারো দ্বারা কোরবানী করতে হবে। ঐ কোরবানী সম্পন্ন হওয়ার পরে উহরাম খুলতে পারবে।
ইহরামের সুন্নাত এবং মুস্তাহাব সমূহ : (১) হজের মাসসমূহে ইহরাম বাঁধা (২) ইহরামের নিয়তে ইহরামের পূর্বে গোসল ও অজু করা (৩) সেলাই বিহীন একটি চাদর গায়ে দেয়া এবং অন্যটি পরিধান করা (৪) দুই রাকাত ইহরামের সালাত আদায় করা (৫) তালবিয়া পাঠ করা (৬) তিনবার তালবিয়া পাঠ করা (৭) পুরুষদের উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা (৮) ইহরামের নিয়থকরার পূর্বে সুগন্ধী ব্যবহার করা (৯) ইহরামের পূর্বে উত্তমরূপে দেহের ময়লা পরিষ্কার করা (১০) নখ কাটা, (১১) বগল পরিষ্কার করা (১২) নাভীর নিচের পরশ পরিষ্কার করা (১৩) নতুন বা ধৌত করা সাদা কাপড় (চাদর) পরিধান করা (১৪) পুরুষদের দুই ফিতাওয়ালা চপ্পল পায়ে পরা (১৫) ইহরামের নিয়ত পুরুষরা উচ্চস্বরে পড়া (১৬) সালাতের পর বসা অবস্থায় নিয়ত করা। (আলমগীরী ১ম খÐ)
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ হারাম : (১) নিচুক বা থুতলি হতে উপরের অংশ মাথায় অংশ হিসেবে গণ্য। তাই ইহরামরত ব্যক্তি তা আবৃত করবে না। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ) (২) পুরুষরা সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করা (৩) ইহরামরত মহিলার জন্য মুখে নেকাব পরিধান বা মুখ আবৃত রাখা (৪) জাফরান, কুসুম বা সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা রং করা কাপড় পরিধান করা। যদি কাপড়টি ধোয়ার কারণে গন্ধ দূর হয় তাহলে পরিধান বৈধ। (৫) পুরুষদের জন্য ঘুমে অথবা জাগ্রত অবস্থায়, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যেভাবে হোক মাতা কিংবা চেহারা ডেকে রাখা। (৬) এমন জুতা পায়ে পরা যাতে পায়ের মধ্যবর্তী উঁচু হাড় ঢেকে যায়। (৭) মুখ, চুল ও গোঁফ কাটা অথবা কাউকে দিয়ে কাটানো এবং শরীরের লোম কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা। (৮) মাথায় ও দাঁড়িয়ে এমন হাত বুলানো, যাতে চুল পড়ে যায়। (৯) প্রার্থী শিকার করা অথবা শিকারে সহযোগিতা করা। মশা-মাছি, উকুন, পোকা মাকড় মারা (১০) প্রার্থী শিকারের হাতিয়ার দিয়ে সহযোগিতা করা (১১) প্রাণী তাড়ানো, প্রাণীর ডিম ভাঙ্গা, পালক ও ডানা তুলে ফেলা, শিকারের দুধ দোহন করা, শিকারের ডিম অথবা গোস্ত রান্না করা। (১২) চুল দাঁড়িয়ে খেযাব লাগানো। (১৩) সাবান দ্বারা মাথায় চুল, দাঁড়ি ইত্যাদি ধোয়া। (১৪) ইহরাম অবস্থায় মাথা চুলকানো জায়েজ নয়। তবে বেশী প্রয়োজন হলে খুব আস্তে আস্তে চুলকাবেন যাতে চুল না উঠে এবং উকুন ঝরে না পড়ে। (১৫) গাছপালা কর্তন করা (১৬) কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ, রাগারাগি, গীবত, অপবাদ, হাসি তামাসা, অশ্লীল কথা এবং পাপাচার করা (১৭) ঘাস বা গাছের পাতা বা ডাল ভাঙা (১৮) সুগন্ধিযুক্ত জর্দ্দা খাওয়া ও ধূমপান করা এবং সুগন্ধিযুক্ত টিস্যু ব্যবহার করা। (১৯) পুরুষদের সামনে মহিলাদের বেপর্দায় থাকা বা চলাফেরা করা। (২০) কাপড় ও শরীরে সুগন্ধিযুক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ১ম খন্ড, হিদায়া ১ম খন্ড, শামী ২য় খন্ড)
উল্লিখিত নিষিদ্ধ কাজগুলোর কোনটি সংগঠিত হলে দম (একটি বকরী) কোরবানী করা ওয়াজিব।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক