স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পটু ও তীক্ষ্ণ মেধাবী তৈরি হচ্ছে কি

4

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

জীবকূলে মানুষের মেধা-মননের বিকাশ অপার, অসীম ও অপরিমেয়। আবার সেই মেধা-মনন তথা মস্তিষ্কের বিকাশ এমনি এমনি হয় না। এই বিকাশে অতীতের যেমন প্রভাব থাকে তেমনি ভবিষ্যতেরও প্রভাব থাকে। আর বর্তমানের প্রেক্ষিতের ভূমিকা তো আছেই। এই মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে পরিবেশ পরিস্থিতির নানা ঘটনা-ভাবনার সাথে মিথষ্ক্রিয়ায়। আবার সমাজের নানা মানের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা ও ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদির উপরও নির্ভর করে। তাই যে সমাজ যত বেশি দ্রæত বিকশিত হয় সে সমাজের প্রজন্মদের মস্তিষ্কও দ্রুত বিকশিত হয়। কর্মে পটু হয়। দক্ষ হয়। মেধায় তীক্ষ্ণ হয়। তাই আমাদের শিশু আর জাপানের একই স্তরের শিশুর মধ্যে এত পার্থক্য। পার্থক্য হয়ে যায় শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়াগত পার্থক্যের কারণে। সমাজের মেধা-মননের উৎপাদনশীলতার মান ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে। আমাদের সমাজ এখনও জ্ঞাননির্ভর হয়ে যেমন উঠেনি তেমনি সংস্কার মুক্তও হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে শিক্ষায় তাদের নির্দেশনা আর আমাদের নির্দেশনার মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। দেখা যায় তাদের শিক্ষক কম শিখায়, শিক্ষার্থী বেশি শিখে। আমাদের এখানে শিক্ষক বেশি শিখায়, বিপরীতে শিক্ষার্থী কম শিখে। শিক্ষার্থী কী জানবে, কী শিখবে, কী বোঝবে, কী রকম ফলাফল করবে ইত্যাদি রকমের নির্দেশনা দিয়ে যাই। আর সমাজ চায়, পরিবার চায় শিক্ষার্থী ভাল পাস দিক। আর তা দিয়ে একটা ভাল চাকুরি পেয়ে যাক। তার সাথে শুধু ভদ্র হতে বা ভদ্রতা প্রকাশ করতে পারলেই হলো।
আমাদের দেয়া নির্দেশনায় সমকোন কাকে বলে জানতে পারে। সেই কোণের ছবি অঙ্কন করে দেখাতে পারে, একটি রেখার উপর একটি রেখা লম্ব বা খাড়া হলে সমকোণ উৎপন্ন হয় তাও বোঝিয়ে দিতে পারে। আবার তা পরীক্ষার উত্তরপত্রে লিখে দশে দশ নম্বরও পেতে পারে। এতেই সে ভাল শিক্ষার্থী বলে প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু জাপানের সম্পদবিহীন যুদ্ধবিধস্ত জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে, পাশের দেশ ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব পারার সক্ষমতা দিয়ে ভাল ছাত্র বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীটি সেই বিষয়ে বিশেজ্ঞ ও দক্ষ হতে পারে। ভাল পাশ দিতে পারে। কিন্তু উপযোগিতার বিবেচনায় সে পিছিয়ে থাকতে পারে। এখানেই আমাদের মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এই জন্য নির্ধারিত বিষয়ে সক্ষমতার আচরণ প্রকাশ করতে পারলে এখন হয় না। তার নির্ধারিত বিষয় চর্চা করার পাশপাশি সে সৃজনশীল হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, সে জ্ঞান তৈরি করার কৌশলে দক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, সেই বিষয়টিকে ভিন্নভাবে তার মত করে উত্থাপন করতে পারে কি না, সেই বিষয়ে তার জ্ঞান তৃষ্ণা বাড়ছে কি না ইত্যাদিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। অন্য কথায় শিক্ষায় সে ‘শিল্পী বা কারিগর’ হয়ে উঠতে পারছে কিনা, যা শিক্ষায় গঠনবাদ প্রক্রিয়া বলে। মধ্যযুগ থেকে কোন বিষয় করে দেখাতে পারলে বা অন্যভাবে প্রকাশ করতে পারলেই হল। এখন শুধু প্রকাশ করতে পারলেই হচ্ছে না। সে বিষয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হবে। যাকে শিক্ষা বিজ্ঞানে গঠনবাদ বলা হচ্ছে। এখন শিক্ষায় আচরণবাদকে পিছনে ফেলে দিয়ে শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ ও উপযোগিতার স্বার্থে গঠনবাদের ব্যাপকতা ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে চলেছে। টেক্সবুকে সংরক্ষিত বিষয়জ্ঞান রপ্ত করানো তাদের লক্ষ্য থাকে না। মূল উদ্দিষ্ট্য থাকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়-আশয় ব্যবহার করে সে কি উৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে তা। যদি পাঠ্যপুস্তকের প্রেক্ষিতের বাইরে নতুন প্রেক্ষিতে তার মত করে নতুন কিছু ভাবতে বা করতে না পারে শিক্ষা ফলপ্রসূ হয় না। যদি বইয়ের জ্ঞানের ওজন ১০ কেজি হয়, আবার শিক্ষার্থী সেই বইয়ের জ্ঞানের ওজনের সমপরিমান ১০ কেজি অর্জন করে তা হলেও হচ্ছে না। মানের দিক দিয়ে, সৃজনশীলতার দিক দিয়ে, উৎপাদনশীলতার দিক দিয়ে মানে উন্মত, পরিমাপে বেশি হওয়ার মতো হতে হয়। একজন কৃষক বীজধান বপন করে বীজ ধানের সমপরিমান ফলন ফলালে তো হয় না। মানে-মাপে বেশিই তো হতে হয়। অন্যদিকে সেই দক্ষতায় তার পূর্বের ধারণায় পরিবর্তন আসছে কি না ইত্যাদিও এখন যাচাই করা হচ্ছে। যাতে সে যে কোন পরিস্থিতে নিজের উপযোগিতা প্রমান করতে পারার গুণাবলী অর্জিত হয়েছে তার নিশ্চয়তা পায়। এই জন্য উন্নত মানের শিক্ষায় নির্দেশনা থাকছে, কী জ্ঞান অর্জন করবে। সেই বিষয়ে দক্ষতার মাত্রা কত অর্জন করতে হবে। সেই বিষয়ে সে দক্ষতা অর্জন করলে হবে না। সেই জ্ঞান চর্চায় দক্ষ হয়ে উঠার পাশাপাশি তার নিজস্বতায় দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসছে কি না ইত্যাদি।
আমরা যে পাঠদানের নির্দেশনা দিই তা হলো মধ্যযুগের। পাঠ্য বইয়ের বাইরে না ভাবিলেও চলে। শুধু বোকা কৃষকের মতো বীজধানের সমপরিমান ফলন ফলাতে পারলেই হলো।
এভাবে তো একবিশ্ব, একগ্রাম-একশিটে চলে আসা বিশ্বে সেই বোকা কৃষকের মতো আমাদের প্রজন্মদের পুস্তকে আবদ্ধ রাখা যাবে না। তাকে জ্ঞান অর্জনে, তৈরিতে পটু হতে হবে, মেধা-মননে তীক্ষ্ণ হতে হবে। তবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম সফল হবে সার্থক হবে। ভিন্নভাবে উপস্থাপনার দক্ষতা দিয়ে প্রশ্ন করায় শিক্ষার্থী কিভাবে কৌতূহলী ও তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠতে পারে তার নমুনায় বোঝার বিষয়টি চেষ্টা করা যায়।
যার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, ভেদ বা উচ্চতা নেই তাকে বিন্দু বলে। কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিন্দুকে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করলাম। এখন সেটা শিক্ষার্থীর আত্মস্থ হয়েছে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। নিজের ভাবনায় বলা সম্ভব কিনা তা জানা যাচ্ছে না। এই জন্য যদি অন্যভাবে বলা হয় বিশ্বে দুটি উপাদান আছে, একটি পদার্থ বা কণা ও আপরটি শক্তি বা তরঙ্গ। সব পদার্থের কোন না কোন এক বা একাধিক মাত্রা থাকে, থাকতে হয়। কিন্তু এমন একটি সত্তা বা বস্তু কণা আছে যার কোন মাত্রা নেই অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা উচ্চতা কোন মাত্রাই নেই। কিন্তু আছে। মাত্রা ছাড়া কিছু থাকা অসম্ভব। সেই অসম্ভটি সম্ভব হয় ‘বিন্দু’তে। বিন্দু দিয়ে। বিন্দু পেন্সিলের শীষ দিয়ে ‘ডট’ দিয়ে আকঁলেও সে ডটের এর ক্ষেত্রে এই সব মাত্রা নেই।থাকলেও নেই বলে মেনে নিতে হবে।
এখন সেই বিন্দু থেকেই বিগ ব্যাঙের মহা বিস্ফোরনে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মত জ্যামিতির সব,সব কিছু সৃষ্টি হয়ে চলেছে। যেমন, পাশাপাশি একই দিকে বিন্দু বসতে থাকলে রশ্মি হয়, দুই দিকে অবিরাম বসতে থাকলে রেখা হয়। বিন্দুর দুই দিকে ধারাবাহিকভাবে বিন্দু বসতে থাকা থেমে গেলে তাকে রেখাংশ বলে। দুইটি রশ্মির প্রান্তবিন্দু দুইটি মিলিত হয়ে সাধারণ প্রান্তবিন্দু হলে প্রান্ত বিন্দুতে কোন উৎপন্ন হয়… এভাবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের মত বিন্দু থেকে জ্যামিতিরও সম্প্রসারণ চলতে থাকে। যদি বোধে মননে তা শিক্ষার্থী আত্মস্থ করতে পারে তবে ‘বিন্দু’ সম্পর্কে তার সৃষ্টিশীলতা অর্জিত হবে। এক সময় নিজের মত করে বিন্দু নিয়ে ভাবতে পারবে। সে ভাবনায় উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে। ফলে কৃষক এক কেজি বীজধান থেকে বহু পরিমানে সোনার ফসল ফলাতে পারে বলে সে একজন সফল কৃষক যেভাবে হয়ে উঠতে পারে। সেই শিক্ষার্থীও শুধু বিন্দুর সংজ্ঞায় আবদ্ধ না থেকে বিন্দু নিয়ে নিজস্ব ভাবনায় নানা বিষয় ভাবতে পারবে। সেই ভাবনায় কোন এক সময় হয়তো তার সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পাবে। এখানে শিখন হয়ে উঠে অভিজ্ঞতায় যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা। এতে পরীক্ষার নাম্বারের পীড়ন থেকে সে মুক্তি পেতে পারে। তার আপন ভাবনার স্রষ্টা হয়ে উঠায় সে নিমগ্ন থাকবে। তখন সে যে কোন সময় যে কোন অবস্থায় বিন্দু নিয়ে নানা সৃজনশীল কর্ম প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু হায় আমরা এখন আধুনিক যুগে বাস করেও মধ্যযুগের আচরণবাদি কৌশলে শিখন-শেখানো চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু বিন্দুর সংজ্ঞা বলতে পারলে বা প্রকাশ করতে পারলেই হল। দশে দশ নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু উন্নত বিশ্বে ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আচরণবাদি তথা প্রকাশ করতে পারার সক্ষমতার চেয়ে শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারছে কিনা, তার মত করে মতামত দিতে পারছে কিনা তা গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এখন প্রমাণিত যে আচরণ প্রক্রিয়ায় শিখনে শিক্ষার্থী তীক্ষ্ণ মেধাবী হতে পারে না। তীক্ষ্ণ মেধাবী হতে গেলে তার নিজস্বতায় বিষয়টি প্রকাশ করার ও ভাবার সক্ষমতা থাকতে হয়। তাই আমরা এখন যে শিখণ-শেখানো প্রক্রিয়া চলাচ্ছি তাতে তীক্ষ্ণ মেধাবী গড়ে উঠা সম্ভব না। আর তা সম্ভব না হলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তয়ন শ্লথ হয়ে পড়বে। তাই আমদেরকে শিক্ষা নিয়ে আধুনিক ধারণায় ভাবতে হবে। শিক্ষাক্রমের প্রতি মনোযোগী হয়ে শিক্ষার্থীকে সঠিক প্রক্রিয়ায় শিখনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। তবেই তীক্ষ্ণ মেধাবীদের হাত ধরে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। তাই শিক্ষায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ, খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ