স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম প্রসংগে

5

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(২য় পর্ব- পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গ) প্রচারের সুযোগ নিয়ে মিডিয়া কর্তৃক চিকিৎসককে ভিলেন হিসাবে তৈরী করা এবং জনগণ কর্তৃক এই অপপ্রচারের খেসারত দেয়া ঃ মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে কেউই বাঁচাতে পারবে না। তাই স্বাভাবিক বা রোগজনিত মৃত্যু হলেই ভুল চিকিৎসা হলো- এভাবে প্রচার করাটা অন্যায়,অযৌক্তিক। ‘ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’ এর মতো ঢালাও অভিযোগ পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করে। পাঠকরাও উক্ত সংবাদসমূহ পাঠ করে চিকিৎসকদের ভ্রান্তভাবে দোষী মনে করে।জনগন সেটাই ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে এবং চিকিৎসকের প্রতি অনাস্থা বেড়ে যায়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলে না। কিন্তু তা আর তেমন পুনরায় প্রকাশ করা হয় না। কিংবা স্বল্প পরিসরে প্রকাশিত হলেও তা জনগনের মনে সৃষ্ট আগের ভ্রান্ত ধারনার পরিবর্তন করতে পারে না। মনে রাখা দরকার, সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থায় একজন চিকিৎসক উপাদান মাত্র, কিন্তু কখনই মূল নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রক নন। এর সংগে যুক্ত থাকেন নার্স, টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ড বয়, সুইপার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদের ব্যবস্থাগত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য চিকিৎসককে দায়ী করে সংবাদ পরিবেশন করলে চিকিৎসক ও রোগীর ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব বাড়ে। যা হওয়াটা অনুচিত। সমাজের অন্য মানুষের মতো চিকিৎসকেরও ভুলত্রুটি হতে পারে।তা সারা বিশ্বেই হয়। কিন্তু নেতিবাচক ও ভ্রান্ত সংবাদ বেশী প্রচার করলে চিকিৎসকদের আন্তরিকতার সংবাদটুকু অপ্রকাশিত থেকে যাবে।এ সব সংবাদে জনগন শুধু চিকিৎসকের উপর আস্থা হারায় না, আস্থা হারায় মূলতঃ রাষ্ট্র প্রদত্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর,যার খেসারত দিতে হয় সমগ্র জনগণকে।
ঘ) গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি তুলে ধরার সংবাদ বা প্রতিবেদন তেমন ছাপানো হয় না : স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রæটি-বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরার জন্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপাতে দু’একটি সংবাদপত্র বাদে অন্যান্যদের তেমন দেখা যায় না। কিন্তু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত সংবাদ ঠিকই ছাপানো হয়ে থাকে।
ঙ) চিকিৎসকদের সফলতাকে মূল্যায়ন করা হয় না : ‘ জনাব ওবায়দুল কাদেরের কার্ডিয়াক এরেস্ট এর জন্য সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারী রিসাসেটেশন দেয়া হলো। ইমার্জেন্সি রিং পরিয়ে লাইফ সেভিং প্রসিডিউর করা হলো। হার্ট এটাকের ইমার্জেন্সী ম্যানেজমেন্ট দেয়া হলো, কিডনী ফেইলিউর এর ম্যানেজমেন্ট করা হলো। এগুলি ভুলে গিয়েছে একদিনেই সবাই। এখন ডাক্তার সুন ফিলিপ এর নাম পেপার পত্রিকা ও মানুষের মুখে মুখে। আর আছে দেবী শেঠীর নাম। কিন্তু আগের কাজগুলো প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান স্যার এবং তাঁর টীমের সদস্য চিকিৎসকগন করেছেন। সেটা কেউ জানেওনা,জানলে মানেও না, স্বীকার করতে রাজী নয় এই জাতি (ডা. সাঈদ সুমন, ডাকতার প্রতিদিন ডট কম, ০৫-০৩-১৯)।’
চ) মিডিয়া চিকিৎসকদের সেবাকর্ম ও আত্মত্যাগ এর মূল্যায়ন সেভাবে করে না : ভয়াবহ ডেংগু পরিস্থিতিতে চিকিৎসকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত সেবা দিয়ে গিয়েছিল।একজন সিভিল সার্জন সহ ১০-১২ জন চিকিৎসক মারা গিয়েছিল। অথচ সে সংক্রান্ত কোন সংবাদ বা আলোচনা সব মিডিয়াতে সেভাবে আসেনি। রোগীকে বাঁচাতে অনেক চিকিৎসক নিজের শরীর থেকে রক্ত দিয়েছেন। এমনি ঘটনার জন্য কখনও চিকিৎসককে ধন্যবাদটুকুও দেয়া হয় না। কিন্তু সাংবাদিক ডেকে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের ব্যবস্থা করিয়ে চিকিৎসককে অপমান করা হয়ে থাকে।
ছ) চিকিৎসকদের আত্মদান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় কিংবা অধিদপ্তর এর ওয়েব সাইটে ঠাঁই পায় না : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ত্রয়োদশ ব্যাচের চিকিৎসক ডা. কামরুল হাসান ইন্টার্নশীপ করার সময় জীবনঘাতি ‘নিপাহ ভাইরাস এনকেফালাইটিস’ এর এক রোগীকে চিকিৎসা করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন।রোগের স্বাভাবিক নিয়মে এবং ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় তাঁর এনকেফালাইটিস হলো। চিকিৎসা চললো। কিন্তু মৃত্যু এড়ানো গেলো না। কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার সৈনিক হয়ে সম্মুখ সমরে নিহত হলেন।নিরবে, নিভৃতে রাষ্ট্র তার এক দক্ষ মেধাবী সন্তানকে হারালো। বিউগলড সেলিউট ডা. কামরুল আহসান এর প্রতি। কোথাও লেখা নেই ডা. কামরুল এর আত্মদান এর কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম অসংখ্য ডা. কামরুল এর কাহিনী আছে। চিকিৎসকদের কাঁধে ভর করে এমডিজি, এসডিজি, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এমনি অনেক কিছুই পাচ্ছে রাষ্ট্র। এটা রাষ্ট্রের গৌরব। অথচ চিকিৎসক সমাজের বলিদানের কথা কোথাও লেখা নেই।
স্বাস্থ্য সাংবাদিকতার নেতিবাচক ভূমিকার নেপথ্যে: ক) পত্রিকা বা মিডিয়ার প্রচার বাড়ানো- চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ছাপানো সংবাদ ভ্রান্ত হলেও পত্রিকা বা মিডিয়ার প্রচার বেড়ে যায়। প্রচার বাড়ানোটা সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষের কাছে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের কৃতিত্ব হিসাবে ধরা হলেও প্রকাশিত সংবাদ পরবর্তীতে ভ্রান্ত বলে প্রমানিত হলে এবং উক্ত ভ্রান্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও জনগন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জন্য অপরাধী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উক্ত সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রকে কখনও নিতে দেখা যায় না।
খ) বিদেশী হাসপাতালগুলোর পক্ষে কিছু গনমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব- কিছু গণমাধ্যম বিদেশী হাসপাতালগুলোর পক্ষ নেয়ার কারনেও এ দেশীয় চিকিৎসকদের সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতের পক্ষে কাজ করা এ দেশীয় সংস্থাসমূহ,যাদের মধ্যে কিছু পক্ষপাতদুষ্ট গনমাধ্যমও আছে, যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত ইতিবাচক সংবাদ প্রায় কখনই না ছাপিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এবং ¯্রফে অভিযোগের ভিত্তিতে বড় বড় করে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর শিরোনাম করা হয়। এর ফলে এ দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবার প্রতি জনগনের আস্থা কমে যায়। ফলশ্রæতিতে বিনা অপরাধে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকের গায়ে হাত উঠায়। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটিয়ে রোগীরা বিদেশগামী হয়।
গ) বিদেশী হাসপাতালের চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করা- সিংগাপুর, এ্যাপোলো, বামরুনগ্রাদ, কুইন্স এলিজাবেথ এমনি আরও নামকরা হাসপাতালের এজেন্ট অফিস রয়েছে বাংলাদেশে। এই সব হাসপাতালের এজেন্ট অফিসগুলো বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন দেবার আড়ালে মোটা অংকের অর্থায়ন করছে যেন তারা বাংলাদেশের চিকিৎসা এবং ডাক্তারদের সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে।একজন এজেন্ট এক বছরে যদি কয়েকজন রোগী বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠাতে পারে তবে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে তার পকেটে ঢোকে প্রায় ২০ লাখ টাকা। আমাদের দেশের নামকরা কিছু সংবাদমাধ্যম এই সব প্রসিদ্ধ বিদেশী হাসপাতালগুলোর সাথে জড়িত। তারা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নেতিবাচক উপস্থাপনার পাশাপাশি এসব হাসপাতালের চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে।
ঘ) বিদেশী চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য বিবিধ প্রচারনা- [১] করপোরেট শিষ্ঠাচার: বিদেশে চিকিৎসকদের থেকে আন্তরিক ব্যবহার পাওয়া যায় এমনি ছবি ও ভিডিও সংবলিত বিজ্ঞাপন মেডিয়ায় অনবরত প্রচারিত হওয়া এবং বিদেশী চিকিৎসকদের করপোরেট শিষ্টাচারকে আমাদের দেশের রোগীরা বিদেশীদের আন্তরিক ভদ্রতা হিসাবে মনে করা, [২] করপোরেট সেবা-ব্যবসা: বিদেশে চিকিৎসক কর্তৃক পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ প্রদান করা হয় এমনি তথ্য প্রচারিত হওয়া। যেহেতু বিদেশের বিশ্বমানের চেইন হাসপাতালসমূহের চাকুরীরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের করপোরেট সেবাদানকারী হিসাবে প্রতিটি রোগীকে পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দিতে বাধ্য থাকতে হয় এবং প্রতিটি সাক্ষাতের জন্য ১০০ মার্কিন ডলার বা ১০০০০ বাংলাদেশী টাকা আমাদের দেশের রোগীদের থেকে উল্লিখিত হাসপাতালসমূহ নিয়ে নেয়। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে ¯œাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম