স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর দিন

25

এমরান চৌধুরী

শৈশব-কৈশোরে এবং কলেজ জীবনে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা হলে বন্ধুদের নিয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়া এ রকম অভ্যাস অনেকেরই ছিল। স্কুলের চেয়ে কলেজের ছেলেমেয়েরা বরাবরই এদিকটায় এগিয়ে থাকত। হয়তো কোনো বান্ধবী আবদার করল আজ তাঁকে মর্নিং শো দেখাতে হবে কিংবা শহরের অমুক হলে একটা সুপার হিট ছবি চলছে তা দেখতেই হবে। এ রকম ছবি দেখার জন্য গ্রাম বা শহরের কত ছেলেমেয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া যাবে না। আর ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/ কখন কে ধরা পড়ে কে জানে।’ এ রকম ফাঁদে পড়েও অনেকে প্রাণ খুলে নিজেদের কথাগুলো বলার জন্য ক্লাস ফাঁকির সুযোগ নিত। মা-বাবা বা অভিভাবক জানত তাঁদের প্রিয় ছেলেটি কিংবা মেয়েটি স্কুল-কলেজে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। এভাবে যোগাযোগের ফলে কোনো কোনো যুগলের ঘর বাঁধা স্বপ্ন হয়তো বাস্তবে রূপ পেত। একদিন দেখা যেত মহাধুমধামের সাথে তাদের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়েছে। তবে এর বিপরীত চিত্র ছিল সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ পরিবার ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে মেনে নিতেন না। ফলে ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ গান গেয়ে অনেক ছেলে তার প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনা বুকে নিয়ে দেবদাস সেজে কাটিয়ে দিত সারাটি জীবন। আর মেয়েটি রিক্তের বেদন নিয়ে মা-বাবার মান রক্ষায় হয়ে যেত অন্যের ঘরনী।
তবে সেকালে বেশির ভাগ স্কুল ফাঁকি ছিল নির্মল। নির্ভেজাল দস্যিপনা। স্কুলে যেতে -আসতে কিংবা স্কুল ফাঁকি দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে মেতে উঠত দস্যিপনায়। স্কুলে যাওয়ার নাম করে বই-খাতা বগলে চেপে বের হতো ঘর থেকে। তারপর সুযোগমতো ধান বা আখ ক্ষেেেতর আড়ালে বই-খাতা-শ্লেট লুকিয়ে রেখে চলে যেত মেলায় কিংবা দূরে কোথাও বেড়াতে। কখনো কখনো স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দল বেঁধে হানা দিত কারো বাগান বাড়িতে । প্রতিবেশির আম গাছে উঠে সবচেয়ে ভালো আমগুলো পেড়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া শুরু করত। লিচু গাছের মগডালে উঠে জোরে ঝাড়া দিয়ে লিচু পেড়ে মজা করে খেত। কলার বাগানে ঢুকে হলুদ বর্ণের কলার কাঁদি ভেঙে নিয়ে কোনো এক বাঁশ বাগানের ঝোপের আড়ালে বসে দিব্যি আরামে আস্ত কলার কাঁদি সাবাড় করত। এগুলো ছিল তখনকার ডানপিঠেদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। বাংলা সাহিত্যে স্কুল পালানো ছেলেমেয়েদের নিয়ে রয়েছে অনেক অনবদ্য চরিত্র। এ প্রসঙ্গে আমরা বিশেষভাবে শরৎচন্দ্রের কালজয়ী চরিত্র ইন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ফটিকের কথা স্মরণ করতে পারি। এ চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা তখনকার সমাজচিত্রের পাশাপাশি পেয়েছি ছেলেমেয়েদের প্রতি যতœ ও দায়িত্ববান হওয়ার বার্তা।
আমাদের দেশে বর্তমানে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্যে যেমন হুমকিস্বরূপ, তেমনি উদ্বেগজনক পরিবারের জন্য, সমাজের জন্যে, সর্বোপরি রাষ্ট্রের জন্যে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রত্যেকেই প্রত্যাশা করে একটি সুশৃঙ্খল জীবন। যে জীবনের মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যত বংশধররা বেড়ে উঠবে, প্রতিষ্ঠা পাবে সমাজ জীবনে। কার্যত মা-বাবা, অভিভাবকদের সে আশা বিভিন্ন কারণে ক্ষীণ হয়ে আসছে আজকাল। যে সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা শৃঙ্খলার কথা জানবে, শিখবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাবে সেখানেই যদি তাঁরা ফাঁকি দেয়, অনিয়মিত হয় তাহলে তাঁরা কীভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে তা সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। সেকালে স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীরা এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ত না যা নীতি ও নৈতিকতার অন্তরায় হয়।
সাময়িক বিনোদন আর দস্যিপনাই ছিল তখনকার স্কুল ফাঁকির মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এখন যাঁরা স্কুল ফাঁকি দিচ্ছে তাঁরা কোনো না কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের প্ররোচনায় যে দিচ্ছে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছুদিন আগে কোতোয়ালী থানা পুলিশ বেলা ১১ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত শুধুমাত্র সিআরবি এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ২৬ জন শিক্ষার্থীকে আটক করেছিল। একটি পত্রিকায় এই নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। পরে অভিভাবকদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ রকম সংবাদ দেশের প্রত্যেক অভিভাবককে নিঃসন্দেহে ভাবিত করবে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছিল, শুধু সিআরবি নয় ডিসি হিল, চেরাগি মোড়, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, শিশু পার্ক, ফয়েস লেকসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে এদের ঘুরতে দেখা গেছে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের সবাই উঠতি বয়সী, কোমলমতি কিশোর-কিশোরী। এদের কেউ কেউ নবম- দশম শ্রেণিতে আর কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শুরু করেছে মাত্র।
যে বয়সে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় সেই বয়সটা বড় বিপদজনক। যে কোনো সময় বিপথগামী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা ঐশির কথা ভুলে যাইনি। অসৎসঙ্গে পড়ে মেয়েটা কিভাবে নিজের মা-বাবাকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। আমরা চাই না সমাজে দ্বিতীয় কোনো ঐশির জন্ম হোক। মায়ের পেট থেকে সকল শিশু জন্গ্রহণ করে একটি ফুল হিসাবে। পরবর্তীতে পরিবেশ তাকে যেভাবে গড়ে তুলে তারা সেভাবেই বেড়ে উঠে। যে সব ছেলেমেয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডাবাজিতে সময় কাটায় এক সময় তা তাদের নেশায় পরিণত হয়। আড্ডা না দিলে বা দিতে না পারলে তাদের মন না পাঠে না অন্য কাজে কিছুতেই বসতে চায় না। ফলে আড্ডার মোহে এসব শিক্ষার্থী হারিয়ে যায় লেখাপড়ার মূলস্রোত থেকে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের বেশির ভাগ পরিবার বা অভিভাবক জানেন না তাঁদের সন্তান আড্ডাবাজদের পাল্লায় পড়ে নিয়মিত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অমূল্য ধন ছাত্র জীবনকে হেলায় হারাতে বসেছে। অনেক শিক্ষার্থী আবার নিজের পরিচয় ঢাকতে সুযোগমতো ইউনিফর্ম খুলে ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে রাখে। এভাবে আড্ডা দিতে গিয়ে অসৎসঙ্গে পড়ে অনেকেই ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। তারপর এক একটি নেশার মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে অনেকটা নিজের অজান্তেই পা বাড়ায় চোরাবালিতে। এদের মধ্য থেকেই এক সময় উঠে আসে মাদকসেবী, সন্ত্রাসীর মতো সমাজ বিধ্বংসী চরিত্রগুলো। শুধু তাই নয় যুগল আড্ডা দিতে গিয়ে অনেক নিষ্পাপ কিশোরী কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ভালোবাসার নামে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অকালেই হারিয়ে যায় এই সুন্দর পৃথিবী থেকে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর-কিশোরীরা অপরাধ জগত পা রাখে আডাডাবাজির মাধ্যমে। এ আড্ডাবাজি যদি স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে, মা-বাবাদের চোখে ধুলো দিয়ে হয় তা অবশ্যই মারাত্মক। তাই আড্ডাবাজির প্রবণতার মতো সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদের। তাঁদের মনে রাখতে হবে সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিলেই বা ছেলেমেয়েদের চাহিদামতো টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। নিজের আদরের সন্তানটি নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিচ্ছে কিনা, কেমন বন্ধুদের সঙ্গে সে চলাফেরা করছে, ক্লাস ছুটির পর সঠিক সময়ে বাসায় ফিরছে কিনা তা দেখা এবং তদারকি করার দায়িত্বও কিন্তু মা-বাবার। অভিভাবকদের ব্যস্ততা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির অজুহাতে সন্তানদের দেখাশোনার এ গুরু ভার অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচিত নিবিড় মনিটরিং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি অভিভাবককে নিয়মিত অবহিত করা। এভাবে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই তিন প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক ও কার্যকর প্রয়াসের মাধ্যমেই সম্ভব আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপদগামী হতে বাঁচানো। একটি সুস্থ, সুন্দর, দায়িত্বশীল ভবিষ্যত বিনির্মাণে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস এ সময়ে খুবই জরুরি।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক