সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসে প্রতিফলিত মুক্তিযুদ্ধ

3

ড. মো. মোরশেদুল আলম

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত চেতনা ঔপন্যাসিকের সৃজনপ্রেরণা, মন ও মননে নিঃসন্দেহে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাঁদের অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা ও স্বপ্নের দিগন্ত সুবিস্তৃত হয়। তাঁরা যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাস রচনা করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তাঁর রচিত উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বিবিধ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে যাঁর নাম স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে রূপায়িত করেছেন। শিল্পস্বভাবে অন্তর্মুখী ও মনোবিশ্লেষণপ্রবণ হওয়া সত্তে¡ও সমগ্র অবয়বে মুক্তিযুদ্ধকে রূপদানের ঐকান্তিকতায় তিনি অনন্য। সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের একজন সব্যসাচী লেখক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক প্রভৃতি রচনায় তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার সদর কুড়িগ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম ডা. সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এবং মাতার নাম সৈয়দা হালিমা খাতুন। শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর বাবার কাছে নিজ বাড়িতেই। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে মাধ্যমিক এবং ঢাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যয়ন করেন। তবে পাঠ্য বইয়ের তুলনায় পাঠ্য বহির্ভূত বইই তাঁকে অধিক আকৃষ্ট করে তুলে। তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয় স্কুল জীবন থেকেই। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী আনোয়ারাকে বিবাহ করেন।
সৈয়দ শামসুল হক কোন রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। তবে ১৯৫৩-’৫৫ সালের মধ্যে বামপন্থি রাজনীতির সাথে তাঁর পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছয় মাস ঢাকায় থেকে সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনে যান। সেখানে ১৯৭২ সালে বিবিসিতে চাকরি নেন এবং সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস হচ্ছে: এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), দেয়ালের দেশ (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), খেলারাম খেলে যা (১৯৭৩), নীল দংশন (১৯৮১), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১), ত্রাহি (১৯৮২), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪), অন্তর্গত (১৯৮৪), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), বালিকার চন্দ্রযান (১৯৯০) ইত্যাদি। তবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, মৃগয়ায় কালক্ষেপ ও অন্তর্গত অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনা প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের প্রধান ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার শুধু সাহিত্যিক কর্তব্যই নয়, সামাজিক কর্তব্য। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৬), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯), অলক্ত স্বর্ণপদক (১৯৮২), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৮৩), লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৩), একুশে পদক (১৯৮৪), জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৫), পদাবলী কবিতা পুরস্কার (১৯৮৭), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), টেনাশিনাস পদক (১৯৯০) ইত্যাদিতে ভূষিত হন।
নিষিদ্ধ লোবান সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। এটি ১৯৮১ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র বিলকিস। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ঢাকা থেকে জলেশ্বরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। জলেশ্বরীতে তার মা, ভাই, বিধবা বোন আর তার সন্তানরা থাকত। কিন্তু ট্রেন জলেশ্বরী পর্যন্ত না গিয়ে নবগ্রাম গিয়ে থেমে যায়। কারণ জলেশ্বরীর পথে ব্রিজটি ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেছেন, চোখের সম্মুখে হঠাৎ যেন আগুন জ্বলে ওঠে দাউ দাউ করে। বিলকিস দেখতে পায় জলেশ্বরী পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখতে পায় সে আগুন নিভে গেছে। জলেশ্বরীর বাড়িগুলো বীভৎস ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা শহরে একটিও প্রাণী নেই। বিকট জন্তুর মতো স্তব্ধতা হামা দিয়ে শহরটিকে খাবলে খাবলে খেয়ে চলেছে। বিলকিসের স্বামী আলতাফ পত্রিকা অফিসে কাজ করত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সে নিখোঁজ হয়। ‘আলতাফ কি বেঁচে আছে? যে খবরের কাগজে আলতাফ কাজ করত, পঁচিশে মার্চ রাতে মিলিটারি সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাতের শিফটে ছিল আলতাফ। সে আর ফেরে নি। যে দুটি লাশ পাওয়া গেছে, আলতাফের বলে সনাক্ত করা যায় নি।’ বাঙালিরাও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে। বিলকিসের মনে হয় তার স্বামীও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ‘যদি এমন হয়, যুদ্ধে যোগ দিয়েছে সে? এই যে শোনা যায়, ছেলেরা এখানে পুল উড়িয়ে দিয়েছে, ওখানে গ্রেনেড ছুঁড়েছে, এক গাড়ি সৈন্য খতম করেছে- যদি তার কোনো একটি আলতাফের কাজ হয়? ঢাকায় রাতে যে প্রায়ই গুলির শব্দ শোনা যায়, তার সবই কি মিলিটারির? কোনো একটি কি আলতাফের নয়?’
মুক্তিযোদ্ধা মনসুরের নির্দেশে সিরাজ নামের এক ব্যক্তি বিলকিসকে জলেশ্বরী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। সিরাজের প্রকৃত নাম প্রদীপ। সিরাজ তার ছদ্মনাম। জলেশ্বরী পৌঁছে বিলকিস আলেফ মোক্তারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তিনি বিলকিসকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের কাহিনি বর্ণনা করেন। মিলিটারি আসবার পর বিহারীরা দলেবলে বেরোয়, প্রতিটা বাড়ি ঢুকে তছনছ করে, লুট করে। একদল এসে দেখা পায় মোক্তার সাহেবের। তারপর অন্ধ দেখে বদমাশগুলোর ফুর্তি হয়। আলেফ মোক্তারের গলায় জুতোর মালা দিয়ে, বুকের ওপর জয় বাংলার নিশান লাগিয়ে কোমরে গরু বাঁধার দড়ি বেঁধে সারা শহর তাঁকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। অন্ধ মানুষ, হাঁটতে পারে না, বার বার পড়ে যায়, বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে খাড়া করে, লাথি মারে, টেনে নিয়ে বেড়ায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা বিলকিসের ভাই খোকাকেও হত্যা করে। তারা আলেফ মোক্তারকে খোকার লাশের উপর প্রস্রাব করতে নির্দেশ দেয়। এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেন, ‘‘বোধহয়, গান গাইত, খোকা ভাই এখানে সবাইকে ‘আমার সোনার বাংলা’ শিখিয়েছিল। মার্চ মাসের মিছিলগুলোতে খোকা ভাই সবার আগে থাকত, একেকটা মোড়ে দাঁড়িয়ে সকলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইত। সবার চোখে পড়ে গিয়েছিল খোকা ভাই।” কেউ এ লাশ নিয়ে যেতে পারবে না, এমনকি দাফন পর্যন্ত করতে পারবে না বলে মিলিটারিরা নির্দেশ দেয়। আলেফ মোক্তারের বর্ণনায়, ‘এত বড় পাষাণ, মানুষের অন্তঃকরণ নেই, হুকুম দিয়েছে, লাশ যেখানে আছে সেখানে থাকবে। কেউ হাত দিতে পারবে না। কচি ছেলেগুলোকে কাক শকুনে ছিঁড়ে খাবে, দাফন হবে না।’
বাজারের খোলা ময়দানে খোকার লাশ পড়ে আছে এবং তা দাফন করতে পারবে না- এ বিষয়টি বিলকিসের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক তার ভাইয়ের লাশ দাফন করতে হবে। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়, ‘বাজারের খোলা চত্বরময় ছড়িয়ে আছে লাশ! বেড়াহীন উলঙ্গ দোকানের খুঁটি আঁকড়ে পড়ে আছে লাশ। আলোর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে গলিটা, তার ওপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ। লাশের পর লাশ।’ খোকার মুখে প্রস্রাব করে দেওয়ার কথা শোনার মুহূর্ত থেকে যে ক্রোধ তার ভিতরে তলোয়ারের মতো খাড়া হয়েছিল, এখন তা ঝলসে উঠে। খোকার লাশ দাফন করার জন্য বিলকিস এবং সিরাজ পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মধ্যরাতে বাজারে যায়। খোকার লাশ না পেয়ে তারা সবগুলো লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়। নদীর তীরে টিনের টুকরা দিয়ে নরম মাটি খুঁড়ে কয়েকটি লাশ মাটি চাপা দেয়। ভোর হয়ে আসলে তারা পাটগুদামে আশ্রয় নেয়। মাটিতে পড়ে থাকা লাশের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেন, ‘গলিটা চত্বরে গিয়ে পড়বার মুখেই একটা লাশ কাৎ হয়ে পড়েছিল। মধ্যবয়সী গরীব কোনো রমণী। খাটো শাড়ি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। বুক খোলা। নিচের চোয়াল বিকৃত হয়ে এক পাশে ঠেলে সরে গেছে। রুক্ষ চুলে আধখানা ঢেকে আছে তার মুখ।’ এভাবে রাতে বের হয়ে তারা মাটিতে পড়ে থাকা লাশ জড়ো করে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর চারজন বিহারী সৈন্যের হাতে তারা ধরা পড়ে। তাদেরকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বন্দি করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তারা জানতে পারে সিরাজ অমুসলিম। তার আসল নাম প্রদীপ। তারা প্রদীপ ও বিলকিসকে ভাইবোন বলে মনে করে। এক পর্যায়ে সিরাজ নামধারী প্রদীপকে তারা গুলি করে হত্যা করে।
পাকিস্তানি মেজর বিলকিসকে ভোগ করতে উদ্যত হয়। পাকিস্তানি মেজরের উক্তি, কেন করবে না ? আমার বীজ ভালো। আমার রক্ত শুদ্ধ। রমণী স্বয়ং উদ্যোগী হলে অবশ্যই আমাতে তৃপ্ত হতে পারবে। আমি কি তোমাকে আকৃষ্ট করি ? আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানি হবে, চাও না সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি রেখে যাব, ইসলামের নিশান উড়িয়ে যাব। বিলকিস প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ছলনার আশ্রয় নেয়। তাকে ভোগ করার জন্য শর্ত হিসেবে প্রদীপের লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে বলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সকল আয়োজন সম্পন্ন করে তাদেরকে নদীর তীরে নিয়ে যায়। লাশের মুখে অগ্নি সংযোগ করলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। বিলকিস হঠাৎ মেজরকে আলিঙ্গন করে জ্বলন্ত চিতার আগুনে ঠেসে ধরে। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়, ঠিক তখন বিলকিস তাকে আলিঙ্গন করে। সে আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পর মুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। তার স্মরণ হয়, মানুষ মাটি দিয়ে এবং শয়তান আগুন দিয়ে তৈরি। জাতিস্মর আতঙ্কে সে শেষবারের মতো শিউরে ওঠে। মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস।
বিলকিসের আত্মোৎসর্গ ও মেজরকে পুড়িয়ে মারার মধ্য দিয়ে তার প্রতিশোধ স্পৃহা পূর্ণ হয়। এ প্রসঙ্গে সারোয়ার জাহান বলেন, পাকিস্তানি সৈনিকেরা বাঙালিদের মৃতদেহ দাফন না করার ঘোষণা দিয়ে অজস্র মৃতদেহ শেয়াল কুকুরের জন্যে ফেলে রাখে, পশু আর বাঙালি জাতিকে এক প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। কেননা পশুদের দাফন হয় না। বিলকিস এই অপমানের প্রতিবাদ জানায় অসম্ভব এবং অভাবনীয় এক প্রতিক্রিয়ায়, প্রতিশোধ নেয় আরো অসম্ভব পদ্ধতিতে- ‘মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে’। সমগ্র দেশব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র জলেশ্বরীর প্রতীকে ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। ‘জলেশ্বরীর প্রতীকে সমগ্র বাংলাদেশকেই যেন এ-উপন্যাসে ধারণ করেছেন ঔপন্যাসিক। পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তি ও সমষ্টির টেন্শান, নিরস্তিত্বের যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বময় জীবন-অভীপ্সা রতির তীব্রতাকে শেষ পর্যন্ত ম্লান করে দেয়। বিলকিস এবং আগুনের মধ্যে নির্দেশিত হয় গভীর প্রতীকী তাৎপর্য।’ এ উপনস্যাসের সমালোচনায় বলা হয়েছে, ‘নিষিদ্ধ লোবানে লেখক সংগ্রাম আর বিজয়ের চিত্র নয় বরং পাকিস্তানি সৈন্যদের রিরংসাবৃত্তির উল্লাস অংকনেই অধিক উৎসাহী।’ মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলো বিশ্লেষণ করলে কেবল তাঁর শিল্পীসত্তারই নয়, বাঙালি জাতিসত্তার ক্রমরূপান্তরের ইতিহাসও অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত তাঁর এ উপন্যাসগুলো ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় ।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়