সেবা সহায়তায় স্বচ্ছতা ফিরে আসুক

3

বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। তবে মানুষের নৈতিক অধপতন তার চেয়ে বেশি হয়েছে-একথা দিবালোকের মত সত্য। বিশেষ করে সেবাখাতগুলোর প্রতি নজর দিলে বুঝা যায়, আমাদের নৈতিকতার অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক ও আর্থিক খাত। যদিও অস্বাভাবিক খেলাপিঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন, পরিবার বা গোষ্ঠীর প্রভাবে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে এ খাতটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খাতটিকে দুর্বল করার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকও কম দায়ী নয়! কেননা বিগত বছরগুলোয় অনেক ঘটনা চিহ্নিত হওয়ার পরও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিকে। ফলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকের আস্থা কমেছে এ খাতে। বিগত বছরগুলোয় এ খাত সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এ খাতে এখন দরকার শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ আরো সুদৃঢ় করা। ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ভালো দিক। সরকারের আহব্বানে উন্নয়ন সহযোগীরাও এগিয়ে আসছে। এ খাত সংস্কারের জন্য যে সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, তা পেলে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের কারণে কোন ব্যাংক যেন দেউলিয়া না হয় বা বন্ধ না হয়, সেই দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত চিকিৎসা। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও দীর্ঘদিনেও এ খাতকে সেবা খাত হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির সংবাদ যেন এ খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে। কিছু কিছু চিকিৎসক অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক নির্ধারণ করে দেন। সেখান থেকে তারা অতিরিক্ত মুনাফাও পান। চিকিৎসকদের এ বাণিজ্য ঠেকাতে হবে। দেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসকের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। পেশাদারত্ব থেকে বেরিয়ে চিকিৎসকরা অনিয়মের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তারা বিভিন্ন অসদুপায় অবলম্বন করছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে চিকিৎসকদের। এ খাতকে সেবামূলক হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের শক্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক ১০০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৫০ কোটি ডলার ও যুক্তরাষ্ট্র ২০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি এবং স্বাস্থ্য, সুশাসন ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এ সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি ডলারের সহায়তার মধ্যে পলিসি বেজড ঋণ হিসেবে ৭৫ কোটি ডলার ও ইনভেস্টমেন্ট ঋণ হিসেবে ২৫ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে এ ঋণ অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ঋণ পেতে বেসরকারি খাতে অ্যাসেস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করা, আন্তর্জাতিক মানদন্ডে খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞায়ন করা এবং নতুন গঠিত টাস্কফোর্সের অডিট ফার্মের কার্যবিবরণী বিশ্বব্যাংকে উপস্থাপন করার শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে। গত ১১ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে ছয় সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ টাস্কফোর্সের সার্বিক কার্যাবলি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সমন্বয় করবেন। আশা করি এ টাস্কফোর্স ব্যাংক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সংস্কার ও সুশাসন ছাড়া ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার, আর্থিক সংস্থার ওপর মানুষের আস্থা আরো কমে যাবে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় জনগণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পাওয়া মুশকিল হবে। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ও সংকট থেকে উত্তরণে ব্যাংক খাত বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক খাতে সংস্কার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থা স্থিতিশীল অর্থনীতির পরিচয় বহন করে। রুগ্ন-দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থা রুগ্ন-দুর্বল অর্থনীতির প্রমাণ দেয়। ব্যাংক বা ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অটল আস্থা অত্যন্ত জরুরি। কেননা আস্থা নষ্ট হলে কিংবা না থাকলে গোটা অর্থনীতিতে ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ধস নামতে বাধ্য। তাই ব্যাংককেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি-দুষ্কৃতির প্রতিটি ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত করতে হবে। এসবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও অপ্রয়োজনীয় একের পর এক ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে এ খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। যদিও ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা গ্রাহককে আস্থা ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।