‘সুখী ও অর্থপীড়নমুক্ত শিক্ষকই নিশ্চিত করতে পারেন স্মার্ট বাংলাদেশ’

3

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক আছে, বিতর্ক থাকবে। ভিলেনের ঘৃণা ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়া প্রণয় যেমন শক্ত হয় না, জৌলশ ছড়ায় না তেমনি তর্কবিতর্ক ছাড়া টিকে থাকার মত আগামীর সঠিক পথ তৈরি হয় না। তবে কূতর্ক না হলেই হলো। শিক্ষায় এগিয়ে থাকা মানেই দেশ এগিয়ে থাকা তাতে কারো দ্বিমত নেই। দ্বিমত থাকতে পারে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, শিক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে। এমন কি শিক্ষার লক্ষ্য নিয়েও। কিন্তু শিক্ষায় এগিয়ে থাকা মানেই সমাজ-রাষ্ট্র মেধা-মননে এগিয়ে থাকা তাতে কারো ভিন্নমত থাকে না। থাকতে পারে না। শিক্ষার চাহিদা সর্বকালীন ও সর্বজনীন বলে এবং শিক্ষাকে সময়োপগী রাখতে হয় বলে সেটার ধারা ও গতিপথের মান নিয়ে, চাহিদা নিয়ে সর্বদা আলোচনা সমালোচনা থাকবে, বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে নানা বাঁধা ও প্রতিক‚লতার সম্মুখিন হতে হবে। সমস্যা সমাধানের পথ নিয়ে বাকবিতন্ডা হবে। লক্ষ্য একটাই শিক্ষাকে এগিয়ে রাখা, মানসম্মতভাবে ও চাহিদার উপযোগী করে। এই যে এগিয়ে থাকার প্রত্যাশা করা, এগিয়ে নিতে তাড়িত হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার সফলতা নির্ভর করে শিক্ষার সাথে জড়িত শুধু উপাধানগুলোর উপর নয়, মূলত শিক্ষকের উপর। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠানো দরকার যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো থাকার পাশাপাশি কোন ধরণের শিক্ষক থাকতে হয়।
অবশ্যই সুখী শিক্ষক। একজন দুঃখী শিক্ষক প্রকৃত ভাল শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারে না। তাই শিক্ষককে সুখী করার সূচকে উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশ এগিয়ে। একটি বই কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বইটির সূচিপত্রতে চোখ বোলালেই বোঝতে পারা যায়। তেমনি কোন দেশ সভ্যতায় ও শিক্ষায় কতটুকু তা সে দেশের শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতা যাচাই করলেই বোঝতে পারা যায়। তাই সামাজিক মর্যাদার শীর্ষে রাখা হয় শিক্ষককে। সেই মর্যাদার শীর্ষস্থান সুনিশ্চিত করার জন্য শিক্ষককে আর্থিক পীড়ন হত্র মুক্ত রাখা হয়। ফলে মানসম্মত শিক্ষক সহজেই গড়ে উঠে। আর মানসম্মত শিক্ষকই মানসম্মত শিক্ষা জাতিকে উপহার দিতে পারেন। সেই দিক দিয়ে আমরা কোথায় আছি তা না ভেবে শুধু মানসম্মত শিক্ষা ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা ভাবলে ও করার চেষ্টা করলে হবে না। শিক্ষাদান তথা দক্ষতা শিক্ষক হতে শিক্ষার্থীর নিকট হস্তান্তর বা সঞ্চালন একটি প্রক্রিয়া। যা মানবিক ও শৈল্পিক। তাই এখানে কায়িক শ্রমিকের কাজের মত কাঠি দিয়ে হিসাব করলে হবে না। হবে না এই জন্য যে শিক্ষায় অর্জিত ফলাফল যেমন দৃশ্যমান আবার কিছু ফলাফল অদৃশ্যমান, সুদূর প্রসারি।
দেখা যাক, একটি ঘরে সব কিছু থাকল শুধু দরজা দেয়া হল না, রান্নার সব আয়োজন করা হল কিন্তু ইন্ধন জ্বালানি তেমন ভাল হলো না, বাজনা বা ব্যান্ডপার্টির জন্য ভাল ভাল নামীদামী ইন্সট্রুমেন্ট তথা যন্ত্র আনা হল কিন্তু যন্ত্রী বা গায়ক সুস্থ থাকতে পারল না। তা হলে সব, সব কিছু আকার্যকর হয়ে যায়। শিক্ষাকার্যক্রমের তেমনি মানবীয় যন্ত্রী বা শিল্পী হলেন শিক্ষক। আবার শুধু যন্ত্রী হলে হয় না, ভাল মানের যন্ত্রী হতে হয়। আবার শুধু ভাল যন্ত্রের ঝঙ্কারে ভাল সংগীত হয় না, সৃষ্টিশীল ভাল যন্ত্রী দিয়েই ভাল সঙ্গিত হয়। তাই আগে সেই মানবীয় উপাদান শিক্ষককে সুখী করা চাই। প্রথাপীড়ণমুক্ত পরিবেশের শিক্ষক চাই, সংস্কারমুক্ত উদার সৃষ্টিশীল শিক্ষক চাই। চাই এই জন্য যে, শিক্ষায় সন্তান বা প্রজন্মদের ভবিষ্যৎকে অবহেলা করতে পারি না। শিক্ষায় তারা ব্যক্তি সম্পদ হয়ে উঠার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজেরও সম্পদ হয়ে উঠে, দ্বায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠে এই শিক্ষকের ‘জীবন’এর বিনিময়ে। তাই আমরা সন্তানের ভালর জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারি, অভিভাবক হিসাবে, পিতামাতা হিসাবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে আমরা চাই শিক্ষককে শিক্ষকের পূর্ণ মর্যাদায় আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতার প্রতিষ্ঠায় রাখতে। যাতে শিক্ষার মত সৃজনশীল কর্মে তিনি তাঁর সমস্ত মেধা-মনন উজাড় করে দিয়ে শিক্ষদান করে যেতে পারেন।
সব ধরনের কাজ ও কাজের প্রভাব ও ফলাফলের মধ্যে একমাত্র শিক্ষকের কাজ ও প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদের হয়, চিরকাল ত্বারণিকভাবে কার্যকর থাকে। অতীতের প্রয়াত শিক্ষকগণের শিক্ষা ও গবেষনার কাজ যেমন শিক্ষার আতীত ভিত্তি তৈরী করেছেন (যেমন, নবী রাসুলগণ, গ্রীক দার্শনিকগণ) যার উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান শিক্ষা কার্যকর থাকছে, ত্রি-জি, ফোর-জি এর মাধ্যমে ডিজিটেলাইজড দেশের স্বপ্ন পূরণ করে চলেছে, আবার বর্তমানের শিক্ষাকার্যক্রম দিয়ে বর্তমান যেমন তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের পথ ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের কাজও বাস্তবায়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলা হবে। এসব তো হয়েছিল, হচ্ছে ও হবে শিক্ষকদের কার্যকারিতায়, মর্যাদাশীল উন্নত জাতি নির্মিত হয় তো শিক্ষক দিয়েই। তাদের বিকল্প তো কিছু নেই। অন্য দিকে এই শিক্ষকই আমাদের প্রজন্মদেরকে তাদের ঘামে-শ্রমে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ করে তুলেন। যা মর্যাদাশীল জাতি গঠনের আবশ্যক উপাদান।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন জানাচ্ছেন সক্ষমতা অর্জনই উন্নয়ন। উন্নয়ন শুধু পুঁজির যোগান দিয়ে হয় না। প্রজন্মদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া মানে উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আর এই সক্ষমতাকে গড়ে তুলার প্রধান ভূমিকায় থাকেন শিক্ষক। এখানে সক্ষমতা মানে একজনের যা কিছু আছে তার ক্ষমতা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়াকে বুঝানো হয়েছে। তাই শিক্ষকদের মর্যাদাশীল ও গুণগত দ্বায়িত্ব পালনকে সুনিশ্চিত করার জন্য তাঁদের আর্থিক সক্ষমতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সামজিক ক্ষমতায়নকেও প্রাধান্য দিতে হবে। আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক ক্ষমতা বাড়ানো মানে তাঁকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিয়ভাবে এবং আর্থিকভাবে যেমন তার মর্যাদার মাপকাঠি নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা তেমনি রাষ্ট্রিয় পদমর্যাদায় তাকেঁ সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া।
তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। বেসরকারি সব পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্মানজনক পৃথক পূর্ণাঙ্গ বেতন স্কেল চালু করা, এলাকা ভিত্তিতে অন্তত একই জেলা বা বিভাগের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ, সমাজে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে শিক্ষকদের উদ্ধুদ্ধকরণসহ নানাবিধ কাজে উৎসাহিত করা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, যন্ত্র তখন মঙ্গল সাধন করে যন্ত্রী যখন মানুষ হয়ে উঠে।
বাঙালি জাতির মানস গঠন সুষ্ঠু ধারায় হতে না পারায় ও হাজার বছর ধরে শোষিত ও নির্যাতিত হয়ে আসায় শিক্ষায় পরিকল্পিতভাবে সবাইকে সক্রিয় করে তুলতে পারিনি। তা না পারায় রাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় চেতনার সর্বোচ্চস্থানে শিক্ষাকে রাখতে পারিনি। যার জন্য শিক্ষার জন্য যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে, শিক্ষকের মর্যাদা ও আর্থিক সক্ষমতার জন্যও লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পাকিস্তানি শাসনামল থেকেই তা চলছে। অথচ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে বিজয় এলো এই বায়ান্ন বছরেও এর সমাধান হয়নি। শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার অর্থ কি সরকারি চাকুরেতে পরিণত হওয়া? না।
১৯৯৪ সালে দেশব্যাপী একটি বৃহৎ শিক্ষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে তৎকালীন শিক্ষক সংগঠনসমূহের লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে। ১৯৯১ সালে তারা প্রণয়ন করেছিলেন ১৫ দফা। যার মূল কথা ছিল বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষালাভের সম সুযোগ-সুবিধা এবং সর্বস্তরের শিক্ষকদের সম অধিকার ও সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদানে নিশ্চয়তা বিধান করে একটি যুগোপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে ১৫ দফার বাস্তবায়ন করা। দাবিগুলো শুধু শিক্ষকদের স্বার্থে তো নয়- সমগ্র দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যেই। সুস্থ দেহের জন্য যেমন প্রয়োজন সুষম খাদ্যের তেমনই শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অর্থপীড়নমুক্ত ও সুখী শিক্ষক। তার জন্য লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি-বাকশিস। এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি শিক্ষকদের ন্যায় সঙ্গত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ায় শিক্ষার মানের সাথে শিক্ষকের অনেক দাবী আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তাই সংগঠনটি শিক্ষকদের প্রাণের সংগঠন হয়ে উঠেছে। এই সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষকের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। তখনই সুখী ও অর্থপীড়নমুক্ত শিক্ষক সমাজ তৈরি হবে। আর সেই শিক্ষক সমাজই পারবে মানসম্মত শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে। আর এতে শিক্ষার্থীর তারুণ্য শক্তিকে পূর্ণদমে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। সেই প্রজন্ম দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। তাই জাতীয় শিক্ষা চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে ও শিক্ষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করতে বাকশিসের সংগ্রামী হাতকে আরও শক্তিশালী করা প্রত্যেক শিক্ষকের কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে। প্রাণের সংগঠন বাকশিস এর চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে সেই সংগ্রামী চেতনাপ্রবাহ আরও খরতর ও বেগবান হয়ে উঠবে শিক্ষক সমাজের সেই প্রত্যাশাই থাকল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা (ডিগ্রি) কলেজ, চট্টগ্রাম