সিদ্ধান্ত কার্যকর হোক

3

কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, বাজেট ঘোষণার সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার রীতি বেশ পুরনো। বিগত সরকারগুলোর আসলে যতবারই কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব বাজেটে উপস্থাপন করা হয়েছে ততবারই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু সরকারগুলো তেমন আমলে নিতেন না। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই বিধি ও রীতি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। আশা করা যায়, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক হবেন।
উপদেষ্টাদের বৈঠক শেষে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখান থেকে সরকার যে টাকা আনতে পারে, সে টাকা দিয়ে যে সরকারের খুব বেশি কিছু এগোয় তা নয়। বরং মূল্যবোধটার অবক্ষয় ঘটে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে বলেও জানান এই উপদেষ্টা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান বহাল রাখা হয়েছিল। এতে সমালোচনা হলেও কোনো পরিবর্তন আনেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান জোরালো করতে অন্তবর্তীকালীন সরকার এই বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা যায়। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, কালো টাকা সাদা করার বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল হচ্ছে না। সিকিউরিটিজ, নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিট অপ্রদর্শিত থাকলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধান ছিল। বর্তমানে এই বিতর্কিত সুবিধাটি বাতিল করা হচ্ছে। তবে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধানটি বহাল থাকছে। শিগগিরই এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বা অর্থ সাদা করার পরও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে কোনো বাধা না থাকার প্রভাব পড়ে কালো টাকা সাদা করায়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেউ কালো টাকা সাদা করেনি। তবে এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করেন দুই হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণে তা এক হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তখন ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেন। কালো টাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এই সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। সেখান থেকে তৎকালীন সময়ে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরে এই সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালো টাকা সাদা করার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় চার কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের সাত বছর অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের মোট ৫০টি দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো এমন ব্যবস্থা করেনি কোনো দেশ। ওই সব দেশে সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সুযোগ না নিলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বারবার সুযোগ দেওয়ায় কালো টাকার মালিকরা মনে করেন, ভবিষ্যতেও এই সুযোগ পাওয়া যাবে।
কালো টাকা সাদা করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্ছ্বার ছিলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। তারা বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এই উদ্যোগকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখেছেন এবারের বাজেটের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘এই সুযোগ দেওয়াটা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। সংবিধান এটা সমর্থন করে না। আবার ফৌজদারি আইনে যে কাজ করা অপরাধ, সেটা আপনি বিনা শর্তে ক্ষমা করে দিতে পারেন না। অবৈধ টাকা উপার্জন তো অপরাধ। তাহলে যিনি এই অপরাধ করেছেন তাকে বিচার ছাড়াই ক্ষমা করে দিচ্ছেন, এটা কোনোভাবেই ঠিক না। আমরা মনে করি, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি শুধু অর্থনীতির বিষয় না, এটা নৈতিকতারও বিষয়। আমরা মনে করি, করি নৈতিক কারণেও এই সুযোগ দেওয়া উচিত না।