সাগর-নদীর ১৭ কিলোমিটার বাঁধে ১৩৮ স্পটে ভাঙন

5

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়াবহ বন্যায় পানির তোড়ে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির ১৭ কিলোমিটার বাঁধ ও নদীর তীরের ১৩৮ স্পটে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে বঙ্গোপসাগর ও সাত নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯ উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকা দ্রুত সংস্কারে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। কয়েকটি স্পটে জরুরী ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধ কাজ শুরু হলেও কবে নাগাদ অর্থ বরাদ্দ মিলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। যে কারনে বাকি স্পটে সংস্কার নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলের কারণে নদী ও খালের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় ভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, কাপ্তাই, রাজস্থলী, রাউজান, কাউখালী, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, দিঘিনালা, পানছড়ি, সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, বোয়ালখালীর উপর দিয়ে বয়ে চলা সাতটি নদী ও ২১টি খালে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়াও দুটি উপজেলার সাগরের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও জলোচ্ছ্বাসে সাঙ্গু, হালদী, চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং, ধুরং, কর্ণফুলী নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফটিকছড়ি, রাউজানে হালদা নদীর তীর ও সীতাকুন্ডের সমুদ্র তীরে সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১এ ৪৩টি স্পটের ৫ দশমিক ৩৬০ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা। ফটিকছড়ির নাজিরহাট পৌরসভা, ফটিকছড়ি পৌরসভা, ভুজপুর, সুন্দরপুর, সমিতির হাট, নারায়ণহাট, খিলাম, পাইন্দং, বক্তপুরে হালদা নদী ও ধুরং নদীর তীর ভাঙন, বাঁধের স্লোপ ধস, বাঁধ ওভারটপিং বাঁধের ব্রীচ, ওভারটপিং, সংযোগ সড়ক ভাঙন, টপ ব্লক ধসে ২৩টি স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাটহাজারীর ফরহাদাবাদে দুটি স্পটে হালদা নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের অংশে ওভারটপিং ও টপ ব্লক ধস, চন্দনাইশের বৈলতলীর একটি স্পটে সাঙ্গু নদীর তীর ভাঙন, সাতকানিয়ার উত্তর ব্রাহ্মণডাঙ্গা, ছদাহার দুটি স্পটে সাঙ্গু নদী ও হাঙ্গর খাল ভাঙন, পটিয়ার হাইদগাঁও, ভাটিখাইনের শ্রীমাই খালের চারটি স্পটে তীর, বাঁধের স্লোপ ও টপ ভাঙন, লোহাগাড়ার আধুনগর, পুটিবিলা, চরম্বা, আমিরাবাদের চারটি স্পটে ডলু খালে বাঁধের ব্রীচ ও টঙ্গাবতী খালের পাড় ভাঙন দেখা দিয়েছে। আনোয়ারার জুইদন্ডী, হালদাখালী, রায়পুরে সাঙ্গু নদীর ভাঙ্গনে সাতটি স্পটে ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহীদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে অতিরিক্ত পানির চাপে সাতটি উপজেলার নদী ও খাল তীরের সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকার ৪৩টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ২৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ তিনটি এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধ কাজ চালানো হচ্ছে। স্থানীয় জনগন ও প্রশাসনের সহায়তায় কিছু স্থানে সিনথেটিক ব্যাগ দিয়ে পানি প্রবেশ ঠেকানো হয়েছে। বাকি স্পট সংস্কারে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ মিললেই সংস্কার কাজ করা হবে।’
রাঙ্গামাটি পানি উন্নয়ন বিভাগের ১দশমিক ৯৬৫ কিলোমিটার এলাকার ৪৪টি স্পটে ১১ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে কাপ্তাই উপজেলার শিলছড়ি ছড়া খাল, ছড়া খাল, মিতিঙ্গা খাল, ওয়াজ্ঞা ছাড়, বড়ইছড়ি খালে তীর ভেঙে ৮টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজস্থলির বাঙ্গালহালিয়া খালের একটি স্পটে তীর ভেঙেছে। কাউখালীর ঘাগড়া ছড়া খাল, বাঘাইছড়ির কাচালং নদীর ডান তীরে, রাঙ্গামাটির ডিসি বাংলো এলাকার তিনটি স্পটে ভাঙন হয়েছে। রাউজান পৌরসভা, চিকদাইর, ডাবুয়ার ১৯টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাউজান পৌরসভার সন্দ্বীপ পাড়া, ক্ষেত্রপাল মন্দির, পাল পাড়া, জাহাঙ্গীর আলম বাড়ি, জানালীহাট ব্রীচ, সুলতানপুর, গনি মিয়া বাড়ি এলাকার ডাবুয়া খালের বাঁধের ব্রীচ, চিকদাইরের ডাবুয়া খালের ব্রাহ্মন পাড়া, ক্ষেত্রপাল মন্দিরের পেছনে, সন্দ্বীপ পাড়া, ডাবুয়ার রোহিঙ্গা বিল, কান্দি পাড়া বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা, গড়দুয়ারা, ফরহাদাবাদের চার স্পটে হালদা নদীর তীর ভেঙেছে। বোয়ালখালীর খরনদ্বীপ, করলডেঙ্গা, চরণদ্বীপের তিনটি স্পটে রেগুলেটরের উইং ওয়াল, রাস্তা ও তীর ভেঙেছে। স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়ায় আরপিপি বেড়িবাঁধ ব্রীচ, সরফভাটায় ভূমির খীল এলাকার কর্ণফুলী নদীর বাম তীর, সাবেক রাঙ্গুনিয়ার আইআর-১১ বেড়িবাঁধ ব্রীচ, হোসনাবাদ হদ খালের গাইড বাঁধের ভাঙনে ছয়টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাঙ্গামাটি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা পূর্বদেশকে বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল, বন্যা ও জলোচ্ছ¡াসে প্রাথমিকভাবে ১ দশমিক ৯৬৫ কিলোমিটার এলাকার ৪৪টি স্পটে ১১ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে জরুরী ভিত্তিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হালদা নদীর পানি বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি রাউজানের ১৬টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতাধীন বাঁশখালী, খাগড়াছড়ি সদর, কমলছড়ি, পানছড়ি, দিঘিনালা, স›দ্বীপ, সীতাকুন্ড উপজেলার ১০কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৫১টি স্পট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে শতকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খাগড়াছড়ি সদরের পেড়াছড়া, বট্টলি, গোলাবাড়ি, ভাইবোনছড়া, কমলছড়ির গুঘড়াছড়ি, পানছড়ি উপজেলার ইসলামপুর সড়ক, লতিবান ইউনিয়নের শান্তিপুর, দিঘিনালার তেবাংছড়া এলাকার ৯টি স্পটের ২ দশমিক ৫৫০ কিলোমিটার নদীর তীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁশখালীর সাধরপুর, পুকুরিয়া, ছনুয়া, শেখেরখীলের ২ দশমিক ২৪৭ কিলোমিটার এলাকার ১৪টি স্পটের নদীর তীর ও খালের পাড় এবং ইন্টেরিয়র ডাইক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া ও সোনাইছড়ির আটটি এলাকার ২০টি স্পটের ১ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সি ডাইক ব্রিচ চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘সাগর ও নদীতে পানির উচ্চতা বাড়ায় এবং পাহাড়ি ঢলের তীব্র চাপে ৫১স্পটের প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে। এতে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করছি হয়তো ১৫ কোটি টাকার মতো পাবো। আপাতত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৩-৪টি স্পটে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছি। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।’