সাংসদদের ‘আপনরাই’ ভোটের মাঠে হঠাৎ পর

6

রাহুল দাশ নয়ন

রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই। আজকে যিনি আপন রাতারাতি তিনি পর। এমন রাজনৈতিক মেরুকরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। সাংসদদের এক সময়ের ‘আপনজন’রা এখন ভোটের মাঠে পর হয়েছেন। এতে ভোটের মাঠের হিসেব পাল্টে গেছে। পছন্দের প্রার্থী বেছে নেয়ায় স্থানীয় সাংসদদের সাথে কয়েকজন প্রার্থীর বিরোধ এখন তুঙ্গে। বিরোধের জের ধরে স্থানীয় সাংসদরা পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে কৌশলে কলকাঠি নাড়ছেন। অন্যদিকে সাংসদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভোটে বিজয়ী হতে মরিয়া চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও। তবে সংসদ সদস্য বিরোধী প্রার্থীরা অভিযোগ করছেন, সাংসদরা নির্বাচন প্রভাবিত করছেন। ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। যে কারণে ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সীতাকুন্ডে চেয়ারম্যান পদে মহিউদ্দিন আহমদ মঞ্জু ও মোহাম্মদ আরিফুল আলম চৌধুরী প্রার্থী হয়েছেন। এই দুই নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বিভক্ত হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের বড় অংশটিই কাজ করছে আরিফুল আলমের পক্ষে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এসএম আল মামুন আরিফুলের পক্ষে নিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন মহিউদ্দিন আহমদ মঞ্জু।
চেয়ারম্যান প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমদ মঞ্জু পূর্বদেশকে বলেন, ‘নির্বাচনী পরিবেশ ভালো নেই। নির্বাচন প্রভাবিত করা হচ্ছে। এমপি, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সচিবরা প্রকাশ্যে কাজ করছেন। আমরা তথ্যচিত্র সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনে পাঠাচ্ছি। ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এমপি সিনিয়রস ক্লাবে নিয়ে বৈঠক করছেন। অথচ উনার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। হয়তো আমাকে নিরাপদ মনে না করে অন্য প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন এমপি। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত হচ্ছে না। সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচনের যে চাওয়া সেটি মনে হয় সীতাকুন্ডে পূর্ণ হচ্ছে না।’ এ বিষয়ে সীতাকুন্ডের সংসদ সদস্য এসএম আল মামুনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আনোয়ারায় দুইবারের উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী এবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের আশীর্বাদ পাচ্ছেন না এই নেতা। সংসদ সদস্য অনুসারী সকল নেতাকর্মীরা এবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নানের পক্ষে মাঠে আছেন। অন্যদিকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মোজাম্মেল হক চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। অর্থাৎ নির্বাচনী মাঠে দুই পক্ষের চাপে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদুল হক। আনোয়ারায় চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদুল হক চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি দুই মন্ত্রীর দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। মন্ত্রীকে এক ব্যক্তি বিভিন্ন কমিটি নিয়ে প্রেসার দিয়েছে, ভুল বুঝিয়েছে। আমার সাথে আল্লাহ ও জনগণ আছে।’
মিরসরাইয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান চেয়ারম্যান পদে দ্বিতীয়বারের মতো প্রার্থী হয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্টজন হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন শেখ আতাউরের। তিনি জেলা পরিষদ সদস্য হওয়া ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পেছনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ছায়া ছিল। এখন দুই নেতার সখ্যতা আর নেই। মিরসরাইয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহবুবুর রহমান রুহেলের আশীর্বাদ পাচ্ছেন এনায়েত হোসেন নয়ন। নেতার আশীর্বাদ না পেলেও নির্বাচনী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন শেখ আতাউর।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি মিরসরাইয়ের ঘরে ঘরে প্রচারণায় গিয়ে দেখছি সব আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নেই। বর্তমান বাস্তবতা ও ১৯৭১ সালের বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের অভিভাবকের (ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন) কাছে হয়তো আমার প্রয়োজনীয়তা কমেছে। এটা ডিপ্রেসন, বয়স ও বার্ধক্য থেকে হতে পারে। এটা স্বাভাবিক পরিণতি। বিচলিত হই না। এসব কথা বলতে গেলে লম্বা হয়ে যাবে। অগ্রহণযোগ্য কথা চলে আসবে। এই সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পেছনে অন্য কারো দোষ নেই। প্রিয় অভিভাবকের দোষ। আমার সাথে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা আছে।’
সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মাঈন উদ্দিন মিশন। এক বছর আগে উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচনে এই নেতাকে জয়ী করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। এক বছরের মাথায় দুই নেতার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যে কারণে উপজেলা পরিষদের এবারের নির্বাচনে এমপি বলয়কে সাথে পাচ্ছেন না মাঈন উদ্দিন। এমপির আপনজন থেকে রাতারাতি পর হওয়া মাঈন উদ্দিন অনেকটা চাপে। এই উপজেলায় সাংসদের পছন্দের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম আনোয়ার হোসেন।
সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মাঈন উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে। দলীয় নির্দেশনা থাকলেও এমপি অন্য প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছেন। আমার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল। এখনো সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকার ভোট উন্মুক্ত রাখলেও এমপি উন্মুক্ত নাই।’
সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা পূর্বদেশকে বলেন, ‘দল থেকে যেহেতু এবার কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি সে কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা যাকে ভালো মনে করছে তার পক্ষে কাজ করছে। আমার কাউকে চেয়ারম্যান বানানোর ক্ষমতা নেই। আইনানুযায়ী এমপি হিসেবে আমি কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার সুযোগ নেই। আমি কোনো প্রার্থীর পক্ষে বক্তব্য রেখেছি এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। কেউ যদি মনে করে আমি অতীতেও কাউকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছি সেটি ভুল।’