সম্পর্কের সেতু বিনির্মাণে একটি শিল্প যোগ

3

 

মিখাইল মোহাম্মদ রফিক

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাদেশ আধুনিক শিল্পের আন্দোলনে প্রবেশ করে। তখন বাংলাদেশে শিল্পকলার কোনো প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯ শতকের শেষের দিকে, ব্রিটিশরা কলকাতায় আর্ট স্কুল স্থাপন করে, কলকাতা ভারতের প্রাদেশিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী হওয়ায়, স্থানীয় শিল্প-অনুরাগীদের শিল্পের বিশেষ রূপ অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব বাংলার শিল্পপ্রেমীরাও এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশে শিল্পকলার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্ম ও তাদের খ্যাতি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।জয়নুল আবেদীন ছিলেন এদের মধ্যে অগ্রগণ্য শিল্পী। তাকে বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারত বিভাগের পর, কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশ হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক এলাকা পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ গঠন করে। তখন স্থানীয় শিল্পীরা বাংলাদেশে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেন। ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিকের মতো অন্যান্য নেতৃস্থানীয় শিল্পীরা বাংলাদেশের শিল্প ঐতিহ্যকে ধারণ ও বিকশিত করার তাগিদে শিল্প ও কারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের শিল্পীরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব অর্জন করতে শুরু করে এবং এর সাথে বাণিজ্যিক মূল্যও যুক্ত হতে থাকে। এটি শিল্পীদের, দর্শকদের কাছে তাদের কাজ প্রদর্শনের জন্য শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করতে তাগিদ বোধ করায়। ১৯৬০ এর দশকের মধ্যে শিল্পীরা বিশ্বের অন্যান্য অংশের শিল্প ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হতে থাকে যা তাদের সেই দেশগুলিতে সমসাময়িক শিল্প সম্পর্কে একটি সুন্দর স্পষ্ট ধারণা অর্জন করাতে সাহায্য করে। অনেক শিল্পী প্রশিক্ষণের জন্য ইউরোপ এবং জাপানে গিয়েছিলেন এবং নতুন ধারণা এবং সর্বশেষ কৌশল নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, তবে তারা বেশিরভাগই দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্যে নিমজ্জিত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয় যা পরবর্তীকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের সম্পৃক্ত করে নিয়মিত শিল্প প্রদর্শনী ও উৎসব আয়োজন করতে শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশী শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং প্রশংসা পেতে থাকে। দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত চারুকলা বিষয়ক সর্ববৃহৎ দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বিশিষ্ট শিল্পীদের অংশগ্রহণে এ প্রদর্শনী ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় মাসব্যাপী এ বৃহৎ প্রদর্শনী সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। অন্যদিকে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন ২০১০ এর গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ঢাকা আর্ট সামিটের মতো ইভেন্টগুলির মাধ্যমে সমসাময়িক শিল্প ও সংস্কৃতির দৃশ্যপটকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প ও স্থাপত্যের জন্য আন্তর্জাতিক, অ-বাণিজ্যিক গবেষণা এবং প্রদর্শনী প্ল্যাটফর্ম এর আয়োজন থাকে। চট্টগ্রামে চারুশিল্পী সম্মিলন আয়োজিত প্রদর্শনী ও আর্ট ক্যাম্প বাংলাদেশের চারুশিল্পের বিকাশে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর হাতে গড়া তৎকালীন চট্টগ্রাম সরকারী চারুকলা কলেজ (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এর সম্মানিত শিল্পী শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা এতে তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও অন্বেষনের ক্ষেত্রে আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট হতে পেরেছেন। শিল্পচর্চার শুভবোধে ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান নিবিড়ভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলাকে এগিয়ে নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী, ভাস্কর এদের শিল্পকর্ম দেশে ও দেশের বাইরে প্রদর্শন এবং দেশি-বিদেশি শিল্পী ও শিল্প-অনুরাগী দর্শকদের মাঝে সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা করবার প্রত্যয়ে ‘বাংলাদেশ আর্টিস্ট গ্রুপে’র একটি যৌথ প্রদর্শনী স¤প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত চলা বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে আয়োজিত ‘ইন্দো-বাংলা আর্ট ফেস্ট ঢাকা ২০২৪’ শিরোনামের এ প্রদর্শনীতে দুই দেশের ৫৬ জন স্বনামধন্য শিল্পী অংশগ্রহণ করে ও তাদের ১২৪ টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায়- বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন (আই সি সি আর), ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার ( আই জি সি সি) ভারতীয় হাই কমিশন ঢাকা এ আয়োজনে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রকে আরো সুসংহত করতে উক্ত প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষাল, ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার ঢাকার পরিচালক শ্রী মৃন্ময় চক্রবর্তী, একুশে পদক প্রাপ্ত স্বনামধন্য ভাস্কর- শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী জি. এম. খলিলুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী চৌধুরী ইমরুল, শিল্পী কে. এম. এ. কাইয়ূম, শিল্পী নাসিমা মাসুদ রুবি, শিল্পী এস. এম. ওয়াহিদুজ্জামান, শিল্পী আইভি জামান, শিল্পী উত্তম কুমার বড়ুয়া, শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ, শিল্পী সাইফুল ইসলাম সহ বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারী শিল্পীবৃন্দ ও দর্শনার্থীরা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উপস্থিত হওয়া শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শিল্পী দীপিকা সাহা, শিল্পী স›দ্বীপ ভট্টাচার্য, শিল্পী দেবাশীষ মাইতি, শিল্পী এস. কে. ইকবাল হোসেন, শিল্পী সোমা মাঝি, শিল্পী রেশমি মুখার্জি, শিল্পী জয়িতা সাহা, শিল্পী শ্যামল কুমার নাথ, শিল্পী পার্থ সারথি দত্ত, শিল্পী রাজকুমার পান্ডে সহ ২১ জন ভারতীয় শিল্পী। উক্ত প্রদর্শনী চলাকালীন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান এমপি প্রদর্শনী প্রদর্শন করেন। আমি নিজে উক্ত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহনকারী শিল্পী হিসেবে উপস্থিত হতে পেরে গৌরবান্বিত মুহূর্তকে অনুভব করেছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘মুক্তির দূত’ শিরোনামে বাংলাদেশ আর্টিস্ট গ্রুপ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশী শিল্পীদের যৌথ প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করে। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ বিশ্ব মানবতার জন্য সর্বোচ্চ কল্যানকর এই নীতি শিল্পের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা এবং যৌথ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কৌশল অবলম্বন করে সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষায় ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশ আর্টিস্ট গ্রæপ’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত দেশে এবং দেশের বাইরে ভারত, নেপাল ও ভুটানে একাধিক প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। প্রদর্শনী সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কলাভবন মিউজিয়ামে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চীন, ফ্রান্স, গ্রীস, জাপান, থাইল্যান্ড সহ ১২ দেশের ৬৮ জন স্বনামধন্য শিল্পীদের সংগঠিত করে ‘গেøাবাল ফ্রেন্ডশিপ আর্ট ফেস্টিভ্যাল ইন্ডিয়া-২০২৩’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ভারতের কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাননীয় ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব আন্দালিব ইলিয়াস। একই বছর নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্টদূত জনাব সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরীর সার্বিক সহায়তায় ৯ টি দেশের ৮০ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মাননীয় রাষ্টদূত ও অংশগ্রহনকারী স্বনামধন্য শিল্পীরা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। ‘বাংলাদেশ আর্টিস্ট গ্রæপ’ সাংগঠনিক দক্ষতায় অসামান্য ভূমিকা পালন করে এ ধরনের গ্লোবাল ফ্রেন্ডশিপ আর্ট ফেস্টিভ্যালের আয়োজনের মাধ্যমে শুধু প্রশংসার যোগ্য হবে তা নয় বরং বাংলাদেশের শিল্পীদের তথা বিশ্বের আরও অনেক দেশের শিল্পীদের সম্মিলিত হবার, শিল্প ভাবনা বিনির্মানে কার্যকরী যোগাযোগ ও যৌথ প্রচেষ্টাকে গুরুত্বের সঙ্গে ত্বরান্বিত করতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : সাংবাদিক, নাট্যজন ও চিত্রশিল্পী