সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ কী প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়?

3

বিবিসি বাংলা

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের সম্পত্তির জব্দের জন্য আদালতের দেয়া নির্দেশের পর নানা ধরনের আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে। তদন্ত পর্যায়েই সম্পত্তি জব্দের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আদালতে যে আবেদন করেছেন, আলোচনা হচ্ছে তা নিয়েও।
বেনজির আহমেদের সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় কিছুদিন আগে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশের পর গত সপ্তাহে তার সম্পদ অনুসন্ধানে কাজ করে দুদকের একটি দল।
কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, আইন অনুযায়ী তদন্ত চলাকালে দুদকের অনুসন্ধানকারী দল যদি মনে করে যে, সম্পদ জব্দ বা বাজেয়াপ্ত না করলে বেহাত হয়ে যেতে পারে, তাহলে আদালতের কাছে জব্দ করার নির্দেশ চেয়ে আবেদন করার সুযোগ আছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সংবাদ মাধ্যমে আসা খবরকে বিবেচনায়ে নিয়ে সাধারণত দুদক কোনো পদক্ষেপ নেয় না বরং তারা নিজেদের মতো করে তদন্ত করে তার আলোকে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজীর কম।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আদালতে বেনজির আহমেদের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানকারী দলের কর্মকর্তার পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন করার পর আদালত সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার নির্দেশ দেয়।
বেনজীর আহমেদ অবশ্য তার ফেসবুক পাতায় লাইভে এসে পত্রিকায় তার নামে প্রকাশিত সংবাদগুলোকে অসত্য বলে দাবি করেছিলেন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পুলিশ মহাপরিদর্শকের পদ থেকে অবসরে গিয়েছিলেন বেনজির আহমেদ।
সম্পত্তি ক্রোক বা জব্দ প্রক্রিয়া
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন, তদন্ত বা মামলার যেকোনো পর্যায়ে আদালত কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দিতে পারেন। তবে বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের আগে তদন্ত চলাকালেই আদালতের কাছ থেকে সম্পত্তি জব্দের আদেশ এলো।
খুরশিদ আলম খান বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ পেয়ে কিংবা স্বঃপ্রণোদিত হয়ে যে কারও বিষয়ে তদন্ত করতে পারেন। আইন অনুযায়ী সেই তদন্তের সময়ই অনুসন্ধানকারীদের যদি মনে হয় ওই ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ আছে এবং সেগুলো মামলা হতে হতে বেহাত হয়ে যেতে পারে, তাহলে তখনই অনুসন্ধানকারী ওই সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সাধারণত দুদক পত্রিকার খবরের ওপর ভিত্তি করে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বরং কোনো খবর আসলে সেটি তদন্ত করে তারা অগ্রসর হয়। ফলে তদন্ত কর্মকর্তারা যখন মনে করেন যে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যেতে পারে তখনই অবৈধ সম্পদ যেন সরিয়ে না ফেলতে পারে সেজন্য সম্পদ ক্রোকের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন।
খুরশিদ আলম খান বলছেন, বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রেও তদন্ত পর্যায়েই আদালতে গেছে অনুসন্ধানকারীর আবেদন। তারা হয়তো মনে করেছে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে রাষ্ট্রের অনুকূলে ভবিষ্যতে বাজেয়াপ্ত করার সম্ভাবনা থাকতে পারে। কিন্তু সম্পদ বেহাত হয়ে গেলে রাষ্ট্র তো তা পাবে না। সে কারণে তারা আগেই আবেদনটি করেছে।
তবে অনেক সময় মামলার পর তদন্ত রিপোর্ট আদালতে যাওয়ার পর আদালত কারও সম্পদ ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেয়।
এখন দুদকের ক্ষেত্রে তদন্ত পর্যায়ে ক্রোক বা জব্দ হওয়ার পর সম্পদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই জব্দ অবস্থায় থাকবে। এরপর মামলার সিদ্ধান্ত হলে দুদক মামলা করবে এবং তারপর আবার তদন্ত হবে। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হলে চার্জশিট পাওয়ার পর আদালত অভিযোগ গঠন করবে। এরপর শুনানি হবে। শুনানিসহ সব ধরনের আইনি ধাপ শেষে আদালত যে আদেশ দেয় সেখানেও কারও সম্পত্তি জব্দের বা ক্রোকের আদেশ হতে পারে।
তবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এই আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।
খুরশিদ আলম খান জানান, ‘তবে প্রথমে বিচারিক আদালতের সম্পত্তি জব্দের সিদ্ধান্ত আসার পর ত্রিশ কার্যদিবসের মধ্যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন। তার আবেদনের ভিত্তিতে আদালত যে আদেশ দেবে, তাতে সন্তুষ্ট না হলে তিনি পরে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন’।
তবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, দুদক নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এর ফলে আদালত সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু এমন প্রভাবশালীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার নজির খুব কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা একটা বড় আইনি প্রক্রিয়ার একটি অংশ মাত্র। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ বা প্রভাবশালী এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনের নির্মোহ প্রয়োগ হবে এটা ভাবা সহজ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে কী হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কারণ তিনি প্রভাবশালী ও সরকারি দলেরও ঘনিষ্ঠ, দেখার বিষয় হবে এটা কতদূর পর্যন্ত যায়।
দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জানিয়েছেন, বেনজীর আহমেদের যেসব সম্পত্তি ক্রোক বা জব্দের আওতায় এসেছে তার মধ্যে ‘মোট ৮৩টি দলিলের প্রোপার্টি, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে এই তালিকায়। কক্সবাজারের একটি প্রোপার্টি রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে এটি তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ। এ নিয়ে কিন্তু এখনো মামলা হয়নি। তদন্তের ফল বিশ্লেষণ করে দুদক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।