সময় আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত : সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন সফলতার ভিত্তি

6

ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব¡ অধিক। কারণ ইসলামে প্রতিটি কাজের জন্যই রয়েছে নির্ধারিত সময়সীমা। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরজ করা হয়েছে (সূরা নিসা : ১০৩)। পৃথিবীতে যারা সময়কে যত বেশি মূল্যায়ন করেছেন তারা তত বড় হয়েছেন। পৃথিবীর কোনো শক্তিই সময় ও নদীর
স্রোতকে রোধ করতে পারে না। সময়ও নদীর স্রোতের মতোই প্রবহমান। পৃথিবীতে যারা অহেতুক সময় নষ্ট করে তারা কাল হাশরে এর জন্য কঠিন আফসোস করবে যেমন- ইরশাদ হচ্ছে হে রাসূল যদি তুমি দেখতে অপরাধীরা যখন তাদের প্রতিপালকের সামনে মাথা নত করে বলবে হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শুনলাম এখন তুমি আমাদের পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করো আমরা সৎ কাজ করব নিশ্চয়ই আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী! (সূরা সাজদাহ : ১২)। সময়ের অপচয় জীবনে ব্যর্থতা ডেকে আনে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন তোমরা পাঁচটি জিনিসকে তার বিপরীত পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করবে ও সদ্ব্যবহার করবে। প্রথমত তোমার যৌবনকে বার্ধক্যে আসার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, সচ্ছলতাকে দরিদ্রতার আগে,অবসরকে ব্যস্ততার আগে এবং জীবনকে মৃত্যুর আগে।
মহান আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে সময় হচ্ছে অন্যতম। নিশ্চয়ই সময়, দিন, রাত্রির সমন্বিত রূপ। সময় শব্দটি তিন অক্ষরের ছোট শব্দ হলেও এর ব্যাপ্তিকাল অনেক বড়। সৌর বছরে ৩৬৫ দিন আর চন্দ্র বছরে ৩৫৪ দিন। ঘণ্টার হিসাবে ২৪ ঘণ্টা এবং মিনিটের হিসাবের দিক দিয়ে ১৪৪০ মিনিট। এ সময় হতে এক ঘণ্টা বা এক মিনিট চলে যাওয়া মানে প্রকৃত পক্ষে জীবনের একটা মূল্যবান অংশ কমে যাওয়া। এ কারণে সময়ের যথাযথ ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। সময়ের সমষ্টিই জীবন। মানুষ তার দুনিয়ার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করেছে আখিরাতে সে হিসাব প্রদান করতে হবে। এ কারণে সময়ের সদ্ব্যব্যবহারের জন্য এর যথার্থ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই জন্ম হয়েছে সময় ব্যবস্থাপনা পরিভাষার। এখনো সময় আছে সুস্থ অবস্থা ও নিরাপদ সময়কে মূল্যায়ন করুন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন দুটি নেয়ামত রয়েছে যে ব্যাপারে অনেক মানুষ ধোঁকায় নিপতিত সুস্থতা ও অবসর সময়। হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী।
মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সময়। মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সময়ের গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বয়ান পেশ করেছেন। একাধিক স্থানে তিনি রাত-দিন, দিন-রাতের কসম করেছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন-শপথ রাতের যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের যখন তা উদ্ভাসিত করে (সূরা লাইল : ১-২)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেন-শপথ ফজরের শপথ ১০ রাতের (সূরা ফাজর : ১-২)। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে আপনি ভেবে দেখুন যদি আমরা তাদের দীর্ঘকাল ভোগ-বিলাস করতে দিই তারপর তাদের যে বিষয়ে (মৃত্যু) সতর্ক করা হয়েছিল তা তাদের কাছে এসে পড়ে তখন যা তাদের ভোগ-বিলাসের উপকরণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল তা তাদের কী উপকারে আসবে ? [সুরা শোয়ারা : ২০৫-২০৭]। কোরআনে কারিমের বহু আয়াতে দুনিয়ার সময়ের স্বল্পতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে দুনিয়ার আয়ুর সমপরিমাণ চিরস্থায়ী অনন্তকালের মধ্য থেকে এক বিন্দু পরিমাণ মাত্র। পরকালের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের আয়ু একেবারেই সীমিত। কাজেই সুসংবাদ তার জন্য যে নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনকে সৎকাজ দিয়ে সাজায় এবং হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ ও পথভ্রষ্টতা এড়িয়ে চলে। এভাবেই সে কল্যাণ লাভ করে পার্থিব জীবনে সফল হয় এবং মৃত্যুর পর জান্নাতের নেয়ামতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে বিজয়ী হয়।
পক্ষান্তরে ধ্বংস ও দুর্ভোগ তার জন্য যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে নামাজসমূহ ও ওয়াজিব বিষয় খর্ব করে ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ে পরিণতিতে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয় তার খাদ্য হয় কাঁটাযুক্ত তিক্ত ফল এবং পানীয় হয় পুঁজ ও ফুটন্ত গরম পানি। আফসোস তার জন্য যাকে তার সুস্থতা সীমালংঘন করিয়েছে ফলে সে অবাধ্য ও পাপী হয়েছে। তার অবসর সময় তাকে ভ্রষ্ট করেছে ফলে সে অনর্থক কাজে জড়িয়েছে। তার ধন-সম্পদ ফেতনায় ফেলেছে ফলে সে ধ্বংস হয়েছে। যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে ফলে সে পতিত ও নষ্ট হয়েছে। যাকে তার যৌবনকাল ধোঁকায় ফেলেছে ফলে সে জীর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার অবস্থাকে ভুলে গেছে। আল্লাহর নেয়ামত পেয়েছে কিন্তু সে অবাধ্যতায় মেতে উঠেছে। আপনি কি জানেন না যে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই আল্লাহকে অক্ষম ও দুর্বল করতে পারবে না ? নিশ্চয় তিনি শাস্তি প্রদানে কঠোর ? আপনি কি মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে জবাবদিহিতে বিশ্বাস করেন না ? অতএব যাকে তার সময়ের সুযোগ এবং প্রাপ্তি ও কামনা তার রবের সঙ্গে স্পর্ধা দেখাতে দুঃসাহস জুুগিয়েছে আর অবশেষে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছে সে কীভাবে আবার সুযোগ পাবে দুনিয়ায় ফেরত এসে আমল সংশোধনের? অবশ্যই না সুতরাং রবের কাছে তওবার সুযোগ এখনই উদাসীনতা পরিহার করে সজাগ হওয়ার মুহূর্ত এটাই। সময়কে মূল্যায়ন করে সফলতা অর্জনের মুহূর্ত এখনই।
মৃত্যুকে বাধা দেওয়ার মতো কোনো শক্তি নেই। কোরআনে কারিম ছাড়া সঠিক পথ প্রদর্শকও আর কিছু নেই। অতএব আপনি চিরস্থায়ী আবাসের (বেহেশত) জন্য আমল করুন যার নেয়ামতরাজি কখনো ফুরাবে না ও কমবে না। বরং তার নেয়ামত বাড়তে থাকবে সেখানে বার্ধক্য এসে কারও যৌবনকে নষ্ট করবে না রোগ-ব্যাধির কোনো আশঙ্কা থাকবে না। আল্লাহতায়ালা সেখানে স্বাগত স্বরে বলবেন শান্তির সঙ্গে তোমরা তাতে প্রবেশ করো এটা অনন্ত জীবনের দিন। সেখানে তারা যা কামনা করবে তা-ই পাবে এবং আমার কাছে রয়েছে তারও অধিক। সুরা কাফ : ৩৪-৩৫ আপনারা সেই জাহান্নাম থেকে বাঁচুন যার অধিবাসীকে আজাব ছাড়বে না ; আল্লাহর অকাট্য আদেশ পালন ও কঠোর ক্রোধ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। পাপাচার থেকে বিরত থাকুন যা পাপীকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। মনে রাখবেন মানুষ এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আপনি আপনার দিনগুলোকে সাধ্যমতো সৎকাজে পরিপূর্ণ করুন এবং আপনার আমলনামাকে অসৎকাজ থেকে হেফাজত করুন। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎকর্ম পরিত্যাগের বিধান দিয়ে মানুষের প্রতি তার রহমত ও দয়ার দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কাজেই কেউ যেন গোনাহ করে আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহী আচরণ করে নিজের ওপর রহমতের দ্বারকে বন্ধ না করে।
মানবজীবনের ভবিষ্যৎ সফলতার প্রথম সোপান হল সময়ের সদ্ব্যবহার। উন্নতকামী মানুষ সময়কে ঠিকমতো কাজে লাগিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার পিরামিড গড়ে তোলে। পৃথিবীতে যারা মৃত্যুজ্ঞয়ী যারা মরেও মরে না তাঁরা সময়ের নিগড়ে নিজেদের জীবনবীনাকে বেঁধেই চলেছিলেন। নিজেদের ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দের উপর বেশি নজর না দিয়ে সমাজের মঙ্গলের কথা উন্নতির কথা ভেবেই তাঁরা অনলস ভাবে কাজ করে গেছেন। কঠোর সাধনা করেছেন। জীবনে সময়নিষ্ঠার প্রয়োজন সব থেকে বেশি। সময়ানুবর্তিতাই একটা সফল মানুষের মূল চাবিকাঠি। জীবনের স্বপ্নকে সার্থক ও সুন্দর করতে হলে সময়কে ঠিক ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে। সময়ের মূল্যবোধ একটা দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। শৈশব থেকেই এই সময়ের ব্যবহারের মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের মূল্য আয়ুতে নয় কল্যাণপুত কর্মে। সময় নিষ্ঠা সেই কল্যাণ পুত কর্মের পথ প্রশান্ত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা যেন সময়ের দাস হয়ে না পড়ি সময়কেই আমাদের দাস হতে হবে। সময় চলিয়া যায়/নদীর স্রোতের প্রায়-সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না অথচ মানুষের জীবন সীমিত পরিসরের গন্ডিতে বাঁধা। নানা স্বপ্ন, আশা-প্রত্যাশার নানা কল্পনা নিয়েই মানুষ বাঁচে। তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে জীবনে নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। কিন্তু সময় কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। তাই মানুষের জীবনে সময়ানুবর্তিতার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
মহানবী (সা.) সময়কে গুরুত্ব দিতে এবং একে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে অনেক তাকিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি সর্তক করে দিয়েছেন, প্রতিটি মানুষকে সময়ের হিসাব কিয়ামতের দিন দিতে হবে। তিনি আরো বলেন : কিয়ামতের দিন কোন বান্দা চারটি প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত সামনে যেতে পারবে না সে তার জীবনকালে কোন কাজে ব্যয় করেছে,তার যৌবনকাল কোথায় ক্ষয় করেছে,তার সম্পদ কোথা থেকে আয় করে কোথায় ব্যয় করেছে এবং তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না। উল্লিখিত হাদীসের চার বিষয়ই সময়ের সাথে সম্পর্কিত। তাই এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় যতটুকু সময় পাওয়া যায় আল্লাহর পথে ব্যয় করা উচিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন হে আমার পালনকর্তা আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন ? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। (সূরা মুনাফিকুন : ১০-১১)। মানুষকে এমনিতে ছেড়ে দেওয়া হবে না। আসুন আলস্য উদাসীনতা ও দুনিয়ার মোহ পরিহার করে সময়কে যথাযথ ব্যবহার করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার সুধা পান করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের মানবজীবনে প্রকৃত সফলতা ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করার তৌফিক দান করুক। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট