সত্য ও ন্যায়ের জন্য এক অদ্বিতীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত

6

আজ ১০ মুহররম। পবিত্র আশুরা। আরবি ‘আশুরা’ শব্দটি ‘আশরুন’ শব্দ হতে নির্গত। এটি একটি ক্রমবাচক শব্দ, যার অর্থ দশম। ইসলামের দৃষ্টিতে হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মুহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। ভূ-মন্ডল ও মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই এই দিবসটি বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত। আরব দেশে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও সফর এ চারটি মাস অধিক মর্যাদাপূর্ণ। এই মাসগুলিকে একত্রে বলা হয়, আশহারুল হুরুম বা সম্মানিত মাসসমূহ। পবিত্র কুরআন কারিমের সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, মুহাররম পবিত্র মাস, আর এ মাসের আশুরা তথা দশম তারিখ এই মাসটিকে করেছে আরো মহিমান্বিত। কেননা এ পবিত্র দিনে আল্লাহ তা’আলার হুকুমে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিয়ামতও সংঘটিত হবে এ দিনে। এ দিনে জন্মগ্রহণ করেন প্রায় ২ হাজার পয়গম্বর। আদিপিতা হজরত আদমের (আ.) দেহে পবিত্র রুহ প্রদান, মা হাওয়াকে (আ.)কে হজরত আদম (আ.)এর বাম পাজর থেকে সৃষ্টি, মহাপ্লাবন শেষে নবী হজরত নুহ (আ.) জুদি পাহাড়ে অবতরণ, নমরুদের অগ্নিকান্ড হতে মিল্লাতে আবা ইব্রাহিমের (আ.) নাজাত, ৪০ দিন মাছের পেটে থাকবার পর হজরত ইউনুসের (আ.) নিষ্কৃতি, হজরত আইউবের (আ.) ১৮ বছর পর রোগমুক্তি, হজরত মুসার (আ.) নীল নদ পাড়িদান ও ফেরাউনের সলিল সমাধি, হজরত ঈসার (আ.) ঊর্ধ্বাকাশে গমনসহ অসংখ্য আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এ দিবসটি।
উপর্যুক্ত কারণগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আশুরা হচ্ছে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের শুকরিয়া দিবস তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। কিন্তু ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৬১ হিজরির ১০ মহররমের এ দিনেই ঘটে বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে মর্মান্তিক ও বিয়োগান্ত ঘটনা। এ দিনে বর্তমান ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার মরুপ্রান্তরে আল্লাহর প্রিয় হাবিব, আখেরি নবি হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রিয় দৌহিত্র এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলি ও খাতুনে জান্নাত ফাতেমাতুয জাহরার (রা.) আদরের পুত্র ইমাম হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। শহাদাত বরণের মর্মান্তিক ও বিষাদময় ঘটনায় পূর্বের ইতিহাস অনেকটা ছাপা পড়ে যায়। মুসলিম বিশ্ব আশুরার দিন উদযাপন করেন বটে, প্রধান্য থাকে শোহাদায়ে কারবালার বেদনাবিদূর ঘটনাসমূহ। এজিদ ও তার বাহিনীর নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ, আহলে বায়তের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং একটি অসমাঞ্জস্য ও পরিহাসমূলক যুদ্ধকে উস্কে দিয়েছিল ইয়াজিদ ও তার বাহিনী। সত্য ও ন্যায়ের ধর্মে ও আদর্শে অটল হজরত সৈয়দুনা ইমাম হোসাইন (রা.)কে কোন প্রলোবন ও ভয় মতনত করাতে পারে নি। বরং প্রশিক্ষিত সৈনিক, ভারি অস্ত্র না থাকা সত্বেও নানাজানের পবিত্র ধর্ম প্রকৃত ইসলামকে মোনাফেক ও ভন্ডামি থেকে রক্ষায় নিজের এবং আহলে বায়তের ছোট্ট ছোট্ট সদস্যদের মাতা তলোয়ারের নিচে বিলিয়ে দিয়েছেন। কী ত্যাগ! যার কোন দৃষ্টান্ত এখনও পৃথিবীতে আরেকটি সৃষ্টি হয়নি। এদিনটিকে সুন্নি মুসলমানরা ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যে আলোচনা, মাহফিল ও ফাতেহাখানির মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। অপরদিকে শিয়ারা দিনটিকে শোকের মাতম করে তাজিয়ার মাধ্যমে। তারা মর্সিয়া করে, যা ইসলাম স্বীকৃত নয়। কারণ ইসলামে শোকের বিধান মাত্র তিনদিন। এদিন শোহাদায়ে কারবালার স্মরণ করে তাদের ত্যাগের মহিমা বর্ণনা করা এবং ইসালে সওয়াব করাটাই উত্তম এবাদত। মনে রাখা প্রয়োজন, কারবালার এই মর্মন্তুদ ঘটনা কুটিলতা ও নৃশংসতার দৃষ্টান্ত হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয়। মুসলমানদের উচিৎ হোসাইনের ত্যাগের মহিমা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, যাতে মানুষ সত্য উপলব্ধি করতে পারে। উল্লেখ্য, রমজানের রোজার পূর্বে আশুরার রোজাই ছিল অবশ্য পালনীয়। এজন্য পবিত্র আশুরার দিনে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি রোজা রাখা উত্তম। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে রমজানের পর মুহররমের এই রোজাকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। যাতে অন্য ধর্মের সাথে সাদৃশ্য না হয়, এ জন্য আশুরার দিনের আগে বা পরে মিল রেখে দুটি রোজা রাখার নিয়ম রয়েছে। পবিত্র আশুরার প্রধান শিক্ষাই হল এক আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও নিরন্তর শুকরিয়া আদায় করা। দ্বিতীয়ত কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের নিকট মাথা নত না করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যেকোনো আত্মত্যাগকে হাসিমুখে বরণ করা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘ফিরে এলো আজ সেই মুহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ তাই পবিত্র আশুরার দিন আমাদের প্রার্থনা ‘জয় হউক ন্যায় ও সত্যের’। ইমাম হোসাইন (রা.)এর আদর্শ অনুসরণ করে মিথ্যার বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রামই হোক আমাদের প্রত্যয়।