শ্রম অধিকার, নিরাপদ জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার হোক

4

আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। সংগতকারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শ্রমিক সমাজের কাছে আজকের দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমসময় নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করছিল তখন তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল হে মার্কেট। তাতে শ্রমিকদের আন্দোলন থেমে যায়নি, বরং তা আরো শক্তিশালী হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আট ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এ দিনটি পালনের এবার ১৩৬তম বার্ষিকী। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এ দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হবে। দিবসটিকে স্মরণ করে বাংলাদেশ সরকার একদিনের সরকারি ছুটিসহ সংবাদপত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণি দিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ সম্পাদকীয় ও ক্রোড়পত্র।
ইতিহাস বলছে, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ও উন্নয়নের মূলেই রয়েছে শ্রমিকদের ঘাম আর রক্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সোপানে আরোহনকারী এ বিশ্ব এখনও যা কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তার মূলেও রয়েছে শ্রমদানকারী শক্তির কঠোর পরিশ্রম। সুতরাং সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিক অবশ্যই মূল্যায়িত হবে তার অবস্থান থেকেই। শ্রমিকশ্রেণি শুধু উৎপাদন ব্যবস্থারই অংশ নয়, দেশের নাগরিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম কারিগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখনো শ্রমিকদের নানামুখী বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে শ্রমবাজারের সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষায় এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি তৈরি হয় অথচ তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বেসরকারি পর্যায়ে তিন থেকে চার লাখ। বাকিরা প্রায় বেকারই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপ থাকা সত্তে¡ও এখনো দেশের কলকারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পুরোপুরি অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সুস্থ বিকাশের জন্য অপরিহার্য সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন। এছাড়া বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নানা ধরনের বৈষম্য। পেশাভেদে যেমন মজুরির ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়, তেমনি তারতম্য দেখা যায় লিঙ্গভেদে তথা নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গের ক্ষেত্রে। সমান কাজ করা সত্তে¡ও অনেক ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরি পায়। নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের বিষয়ে সরকার নিরাপত্তামূলক বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও খাতায় আছে বাস্তবে নেই। প্রকৃতপক্ষে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবেই স্বীকার করা হয় না। শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে বিতর্ক আপাতত লক্ষ্য করা না গেলেও স্থায়ী কোন কমিশন না হওয়া পর্যন্ত মজুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজা ধসের পর আমরা বুঝতে পারি আমাদের কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ কত নাজুক। বিশেষ করে পোশাক-শিল্প কারখানা, রি-রোলিং কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প, নতুন নতুন গড়ে উঠা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ইমারত নির্মাণ এবং এমনই আরো কিছু শিল্পে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের জীবন যাচ্ছে। এমন অনেক কারখানা রয়েছে, যেখানে নিয়োগ বা চাকরিচ্যুতির কোনো নিয়মকানুন মানা হয় না। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, বকেয়া পরিশোধ না করেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। এখানে লেবার কোড তথা শ্রমিক আইনকে কোনরকম তোয়াক্কা করা হয় না। বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা প্রণোদনা সত্তে¡ও দেশের অনেক শিল্প মালিক কারখানা লে-অপের ঘোষণা দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই ও তাদের পারিশ্রমিক আদায় না করার সুযোগ নিচ্ছেন। যা আন্তর্জাতিক ও দেশের শিল্প ও শ্রম আইনে সম্পূর্ণ অবৈধ। এছাড়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টিও আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, সরকার, কারখানার মালিক ও সংশ্লিষ্টরা শ্রমের মর্যাদা প্রদানে আন্তরিক না হলে হাজার বছর অতিবাহিত হলেও শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। আমাদের মনে রাখা দরকার শ্রমিকের কষ্টের বিনিময়ে কারখানার চাকা ঘুরে, উৎপাদন বৃদ্ধি পায় আর দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকে। আমরা মনে করি, আই.এল.ও এবং ইউনেস্কোর সুপারিশমালা অনুসারে দেশের সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব¡। এক্ষেত্রে শ্রমজীবীদেরকেও নিষ্ঠার সাথে উৎপাদনে সহায়তার হাত সম্প্রসারণ করতে হবে।
সরকার ও মালিক পক্ষকে সহযোগিতা করার দায়িত্বও শ্রমিকের। এক্ষেত্রে অবহেলা ও অনিয়ম কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে সরকার ও মালিকপক্ষ আন্তরিক হলে সত্যিকারের শ্রম অধিকার, নিরাপদ জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা পাবে, এতে দেশ কাক্সিক্ষত লক্ষে এগিয়ে যাবে- এমনটি প্রত্যাশা আমাদের। আজকের এ দিনে অধিকার আদায়ে যেসব শ্রমিক আত্মত্যাগ দিয়েছেন তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।