শোকাবহ আগস্ট

12

নিজস্ব প্রতিবেদক

দীর্ঘ তেইশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক বছরেরও বেশি সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছে। স্কুলজীবন থেকেই তিনি ছিলেন অন্যায়-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সাধারণ মানুষের উপর শাসকগোষ্ঠী কিংবা প্রভাবশালী চক্রের অত্যাচার-জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি অসীম সাহস নিয়ে প্রতিবাদমুখর হতেন। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য তার হৃদয়ে ছিল গভীর মমত্ববোধ এবং প্রাণ-অফুরান নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এসব গুণই তাকে বাংলার আপামর জনসাধারণের এবং জাতির অবিসংবাদিত জননেতায় পরিণত করে আস্থার আসনে আসীন করে।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বাঙালি জাতির এই মহানায়ককে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অভিশাপ বাঙালি জাতির কাঁধে চেপে বসেছে, তার ফলশ্রুতিতে বাংলার মাটিতে সত্যিকার অর্থে তার মত ব্যক্তিত্বের গণমানুষের আর কোনো নেতার জন্মই হয়নি।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করেছেন। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সাথে সমন্বিত করে ধাপে ধাপে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বন্ধুর পথ। তবে, চলার পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সকল প্রতিবন্ধকতাকে অপরিসীম ধৈর্য ও অসীম সাহসের সাথে মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। তাঁর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে। সাম্প্রদায়িক-রাজনীতির মাধ্যমে হাতেখড়ি হলেও তিনি পথ-পরিক্রমায় ধীরে ধীরে পরিণত হন অসা¤প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহকে। তথাকথিত দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের সামন্ত-মানসিকতা, শ্রেণি-চরিত্র ও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত রূপ প্রত্যক্ষ করেন। অধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল বাংলার নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কল্যাণ সাধন এবং জাতিকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা কিংবা মুক্তি-সংগ্রামের দিকে চালিত করা। স্বাধীনতার চেতনা থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মনে মুক্তির আলোর প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন। জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাগিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তি। আর বজ্রকণ্ঠে মুক্তিকামী মানুষের মুখে তুলে দিয়েছেন অনবদ্য শ্লোগান, ‘জয় বাংলা’। এই ‘জয় বাংলা’ দিয়েই তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে একটি চেতনায়, একটি ভাবধারায় ও একটি আকাংখার লক্ষ্যে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মুক্তির চেতনার অগ্নিমশালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তাবত ষড়যন্ত্র জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার হৃদয়ে ঠাঁই করে নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অবিস্মরণীয় গণ-রায় তারই সাক্ষ্য বহন করে। গোটা জাতিকে তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধে যাওয়ার ডাক দিলেন একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্সে দেয়া এক ঐতিহাসিক ও তেজোদ্বীপ্ত ভাষণে- ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
আর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে। স্বাধীনতার ওই ঘোষণাপত্রটি এরপর অনেকেই তার পক্ষে পাঠ করেন। ‘মরতে শেখা’ বাঙালি জাতি টানা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশকে শত্রæমুক্ত করে কাংখিত স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয়।
ভাষা ও জাতীয়তাবোধভিত্তিক রাষ্ট্র-বাংলাদেশকে একটি দেশের আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন হ্জাার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি শুধু বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেননি, ভাষা শহীদদের প্রতিও জানিয়েছেন অপরিসীম শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের পরিব্যাপ্তি ছিল বাঙালি জাতিসত্তায়। অসীম ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে পা রেখেই ছুটে যান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। যেখানে লাখো মানুষ অপেক্ষা করছিল তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার বজ্রকণ্ঠ শুনতে, তাকে একনজর দেখতে। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুও তাই ভাষণ দিতে গিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। একবার মরে, দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু যদি এসে থাকে, তবে, আমি হাসতে হাসতে যাব। তবুও তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। আমার বাংলা আজ স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ স্বাধীন’।