শিগগিরই বঙ্গোপসাগরকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হবে

7

নিজস্ব প্রতিবেদক

শিগগিরই বঙ্গোপসাগরকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর পতেঙ্গায় র‌্যাব-৭ এর এলিট হলে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকার ১২ জলদস্যু বাহিনীর ৫০ সদস্য। এর মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। পতেঙ্গায় র‌্যাব-৭ এর এলিট হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন তারা। এ ৫০ জনের মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে কোনো মূল্যে অপরাধীদের দমন করা হবে। যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু যারা আত্মসমর্পণ করেননি তাদের কি হবে শুধু আল্লাহই জানেন। সুন্দরবনের মতো শিগগির বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উপক‚লীয় অঞ্চলকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, চিন্তার বিষয় হলো একজন পঞ্চাশোর্ধ নারীও জলদস্যু। মূলত ক্ষমতাশালীদের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেকে এ পথ বেছে নেন।এমন অনেক গল্প আছে। আমরা তাদের সুপথে ফেরার ও সমাজে কিছু করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থা করছি। তাদের মামলাগুলো তুলে নিয়ে সহায়তা করবো। তবে খুন ও ধর্ষণের অভিযুক্তদের মামলা তুলবো না।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, র‌্যাব অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে যখন জঙ্গির উত্থান হচ্ছিল। অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছে র‌্যাব। সুরক্ষা দিতে গিয়ে নিজেদের জীবন দিয়েছে ৩৩ জন র‌্যাব সদস্য।
মন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, চট্টগ্রাম আর আগের মতো নেই। এখানে টানেল হয়েছে, বে-টার্মিনাল হচ্ছে। এখানে কেন দস্যুতা থাকবে? আত্মসমর্পণ না করা জলদস্যুদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা (সরকার) প্রায় ১৫ বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছি। এখন আমরা একটি পিসফুল পরিস্থিতি চাই। যেকোনো মূল্যে অপরাধীদের দমন করা হবে। কেউ যেন অপরাধ করার সাহস না পায়। যারা ফিরে আসেনি তাদের কি পরিণতি হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন।
এসময় জলদস্যুদের আত্মসমর্পণে অবদান রাখায় তিনি সাংবাদিকদের অভিনন্দন জানান। অনুষ্ঠানে নিউজ টুয়েন্টিফোরের বার্তা সম্পাদক সুমন তালুকদার ও সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মীর মোহাম্মদ আকরাম হোসাইনকে ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেয়া হয়।
এর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আত্মসমর্পণ করার পর জঙ্গিবাদ-দস্যুপনায় পুনরায় ফিরে গেলে তাদের ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের পর আমরা তাদের প্রতি বেশি খেয়াল রাখছি। যদি তারা পুনরায় এসবে ফিরে যায়, তাহলে ছাড় দেয়া হবে না। তাদের মামলা তুলে নেয়া ও অন্যান্য সব সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমাদের কথার বরখেলাপ করলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়, আমরা তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। আজকে যারা আত্মসমর্পণ করছেন সবাইকে স্বাভাবিক জীবনে স্বাগত জানাই।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নুরে আলম মিনা, র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ, কোস্টগার্ডের প্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
র‌্যাব বলছে, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার হাজার হাজার উপক‚লবর্তী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কতিপয় চিহ্নিত জলদস্যু ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছে। এসব মানুষের মধ্যে অনেকে জলদস্যুদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। আর এলাকার স্থানীয় অস্ত্র কারিগররা প্রতিনিয়ত জলদস্যুদের দেশে তৈরি অবৈধ অস্ত্রের বড় একটি অংশ সরবরাহ করে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যুদের দমন, স্থানীয় পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারিগর ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে র‌্যাব প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চল জলদস্যুমুক্ত হবার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলের সাগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম আগামির দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে।
অনুষ্ঠানে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশের সীমানার একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই সাগরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিশাল এই উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উপার্জনের অন্যতম আশ্রয়স্থলকে কণ্টকাকীর্ণ করে রাখে কিছু অস্ত্রধারী বিপথগামী জলদস্যু। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে র‌্যাবের কঠোর পদক্ষেপের ফলে ২০১৮ এবং ২০২০ সালে র‌্যাব-৭ এর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপক‚লীয় অঞ্চল হতে সর্বমোট ৭৭ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে।
তিনি বলেন, এর আগে র‌্যাব-৭, র‌্যাব-৬ এবং র‌্যাব-৮ এর তত্ত্বাবধানে বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এবং সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল হতে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অবলোকন করার ফলেও এসব জলদস্যুরা আত্মসমর্পণে অনুপ্রাণিত বোধ করে। প্রধানমন্ত্রীর সদয় সম্মতিতে এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর বিষয়টি এক যুগান্তকারী ঘটনা। এতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপক‚লে জলদস্যু বাহিনীর অপতৎপরতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালী আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের ৪৩ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে। ২০১৯ সালে মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ৯৬ জন, ২০২০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিভিন্ন দুর্ধর্ষ জলদস্যু বাহিনীর ৩৪ জন সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।