শিক্ষা ও সমাজসেবার বাতিঘর মুহাম্মদ বদিউল আলম স্মরণে

8

অধ্যাপক লিয়াকত আখতার ছিদ্দিকী

যুগেযুগে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের উদয় হয় যা সময়ের এক সময় এ নশ^র জগৎ হতে না ফেরার দেশে বাড়ি দেন। তারা জ্ঞান গরিমা, একাডেমিক শিক্ষা ও পরিবেশ পরিক্রমার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ, জাতি ও জনমানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হন। ক্ষণজম্মা কৃতিমান ব্যক্তিত্ব আলহাজ¦ মুহাম্মদ বদিউল আলম তাদেরই মধ্যে থেকে একজন। রাজনীতি, সমাজসেবা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল অদম্য। জীবন ও কর্ম ছিল অনেক ব্যাপক ও সুশমন্ডিত। চিন্তা, চেতনায়, কর্মে, নেতৃত্বে, পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে তার উচ্চসিত উদ্দিপনা ও সাহস ছিল বিস্ময়কর। মরহুম বদিউল আলম ১৯৩৯ সনের ১৫ এপ্রিল মিরসরাই উপজেলা মুহুরী প্রকল্প সংলগ্ন ইছাখালী ইউনিয়নের হাফিজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ফেনী আলীয়া মাদরাসা হতে আলিম, পাঁচলাইশ ওয়াজেদিয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজ হতে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। কর্ম জীবনে তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী।
আবাসিকো প্রা. লি. এর এমডি, সাংবাদিকতায়ও ছিল তার পদচারনা। সাপ্তাহিক আবেদন পত্রিকার ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। ষাট ও সত্তর এর দশকে আদর্শিক ছাত্র রাজনীতি ও পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন সোচ্চার। বিংশ শতাদ্বীর শেষান্তে তিনি সমাজসেবা ও শিক্ষা সম্প্রসারণ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে উদীয়মান হন। তিনি মিরসরাই আসন থেকে সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতাত্তোর কালে তিনি সমাজ সেবায় মনোযোগ দেন। ১৯৮৩-১৯৯৫ দীর্ঘ সময় কালে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য সংগঠন ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চট্টগ্রাম শহরের মাদারবাড়ী, ঝাউতলা, চট্টগ্রাম কলেজ রোড ও চান্দগাঁও শমসের পাড়ায় চাঁদমিয়া সওদাগর বাড়ির পাশে অবহেলিত নিঃস্ব মানুষের চিকিৎসার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠায় নিরলস ভূমিকা পালন করেন। যা আজ চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হিসাবে পূর্ণতা লাভ করেছে। এ মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ গড়ে তুলতে মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ও মরহুম ডাক্তার মুহাম্মদ রফিকের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।
মরহুম বদিউল আলমের উচ্চ শিক্ষা সম্প্রসারনে অবদান অসাধারণ। তিনি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে আল জাবের ইনষ্টিটিউট এন্ড কলেজ, জামালখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ ইনস্টিটিউট, কাট্টলীতে জামান আনোয়ার ইনস্টিটিউট ও নাসিরাবাদে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) মাদরাসা, হিফজ ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ গ্রামে মাদবরহাট সিনিয়র মাদরাসা, এডুকেশন সেন্টার ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
মরহুম বদিউল আলমের জীবনের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ ও চট্টগ্রামের খ্যতিমান শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯৯২ সালে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বায়তুশ শরফ এর মরহুম পীর সাহেব শাহ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ.), পরিষদের সভাপতি মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দিন, অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহের ও মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় ওওটঈ প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নেন। তিনি চট্টগ্রামের স্বনাধন্য শিক্ষাবিদ চ.বি এর ড. মঈনুদ্দিন আহমদ খান, প্রফেসর মুহাম্মদ আলী, (যিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যাঞ্চেলর ছিলেন) ডক্টর মুহাম্মদ লোকমান ও প্রফেসর আবু বকর রফিক প্রমুখের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এই দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদন করেন।
বিশ^বিদ্যালয়ের আর্থিক ফান্ড সংগ্রহে তার সহযোগিতায় ছিলেন প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী ও ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মদ। মরহুম বদিউল আলম বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টের আমৃত্যু প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে দেশ, জাতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় সুনাম, সুখ্যাত একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ। মরহুম বদিউল আলম চট্টগ্রাম সাউদার্ন ইউনির্ভাসিটির এক চরম সংকট কালে চেয়াম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্তিত্ব রক্ষায় স্মরণীয় ভ‚মিকা রাখেন। তার এই কাজটি পাশে থাকা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বড় উদার মনের মানুষ। তিনি ছিলেন শিক্ষা ও সমাজসেবার বাতিঘর।
মরহুম বদিউল আলম ২০০৯ সালের ১২ইং জুলাই ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তার অবদানসমূহকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ প্রাবন্ধিক ও সমাজসেবক