শিক্ষার্থী-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ষোলশহর

30

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নগরীর ষোলশহর ২নং গেট এলাকা। এ সময় দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে। গতকাল সোমবার বিকাল ৫টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
এর আগে দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ষোলশহর সড়কের ওপর অবস্থা নেন। অপরদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে অবস্থান নেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে নগরীর ষোলশহর স্টেশনের সামনে রেললাইনের ওপর বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিলেন কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ৫টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অতর্কিতে হামলা করে। এসময় আন্দোলনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে মারধর করে আহত করার অভিযোগ উঠে। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলে উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিল। ঘটনাস্থলে থাকা পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা সংঘর্ষের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উত্তর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মোখলেছুর রহমান বলেন, কোটা সংস্কারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ষোলশহর এলাকায় বিক্ষোভ করছিল। ছাত্রলীগের একটি মিছিল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পুলিশ উভয় পক্ষকে শান্ত করে। পুরো ঘটনায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে আন্দোলনের ফলে মুরাদপুর, ষোলশহর, ২নং গেট ও জিইসিসহ আশপাশের পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।
বাস চালক হুমায়ুন বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে রাস্তায় অপেক্ষায় আছি। উপায় তো নেই। প্রতিদিনের মত আজকেও একই দশা হবে। গতকাল রোববার) মনে করছিলাম, আজ (সোমবার) থেকে আর আন্দোলন হবে না। এখন দেখি সবাই রাস্তায়।
সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয় জানিয়ে পাঁচলাইশ ট্রাফিকের পরিদর্শক মো. মাসুদুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, দুপুর থেকে ষোলশহর স্টেশনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে মুরাদপুর এবং ২নং গেট এলাকায় ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী অবস্থান করেন। সন্ধ্যা ৭টার পর শিক্ষার্থীরা চলে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর আগে দুপুর আড়াইটার ট্রেন আটকে দিয়ে ট্রেন থেকে কোটা আন্দোলনের চবি সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফিকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ নেতারা।
শিক্ষার্থীরা জানান, তালাত মাহমুদ রাফিসহ অন্যান্য আন্দোলনকারীরা দুপুর আড়াইটার ট্রেনে করে শহরে কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় চবি শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রæপের নেতাকর্মীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে উপস্থিত হয়ে শাটল ট্রেন আটকে দেন। এরপর ট্রেন থেকে সমন্বয়য়ক রাফিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে জোরপ‚র্বক ছাত্রলীগের মিছিলে যুক্ত করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। প্রক্টর অফিসে রাফির ছাত্রত্ব বাতিলের জন্য প্রক্টরকে চাপ দিতে থাকেন। এসময় রাফির হাতে থাকা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাও ছিনিয়ে নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
এদিকে রাফিকে ধরে নেওয়ার খবর জানাজানি হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে প্রক্টর কার্যালয়ের দিকে রওনা হন। মিছিলটি শহীদ মিনারের সামনে এলেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেন। এতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান এবং ঘটনাস্থলেই লাঠির আঘাতে মাথা ফেটে এক শিক্ষার্থী রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আহত ওই শিক্ষার্থীর নাম মাহবুবুর রহমান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের অধ্যয়নরত।
আন্দোলনকারীরা জানান, এসময় আরাও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কাটা পাহাড় সড়কে তাড়া করে মারধর করতে দেখা গেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। ছাত্রলীগের এলোপাতাড়ি এ হামলায় ৫ জন আন্দোলনকারীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
হামলার পর পরেই আন্দোলনকারী ছাত্রীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের সামনে এসে জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়। এসময় সেখানে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও পাল্টা স্লোগান দেন। আন্দোলনকারীরা জানান, সমন্বয়কারী রাফিকে যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদে ক্যাম্পাসের বাইরে পৌঁছে দেয়া না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রক্টর অফিসের সামনে থেকে সরবে না। এক পর্যায়ে ছাত্রীদের দাবির মুখে প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলম রাফিকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে অফিস থেকে বের করলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তার সামনেই রাফিকে মারতে তেড়ে আসে। প্রক্টর পুনরায় রাফিকে অফিসের ভেতরে নিয়ে যান। পরে প্রক্টর অফিসের সামনে অবস্থানরত ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিয়ে নিজ নিজ হলে পাঠিয়ে দেয় প্রক্টরিয়াল বডি।
কোটা আন্দোলনের চবির সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, আমাকে জোর করে ছাত্রলীগের মিছিলে যুক্ত করে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়েছে, আপনারা সবাই দেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ (সোমবার) বিকাল সাড়ে ৩টায় আমাদের আন্দোলনকে বন্ধ করতে ট্রেন আটকে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (উপগ্রুপ সিক্সটি নাইনের নেতা) পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, তালাত মাহমুদ রাফি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এরপরও যেহেতু সে কোটা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, তাই তার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার নেই। আমরা প্রক্টরের কাছে তার ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি জানিয়েছি। তিনি আরো বলেন, যারা নিজেদের রাজাকার বলবে তাদের এ দেশে ঠাঁই নেই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কোনো রাজাকারকে এদেশের মাটিতে প্রশ্রয় দেবে না। যারা রাজাকার রাজাকার স্লোগান দিয়েছে তাদেরকে ক্যাম্পাসে কোনো আন্দোলন করতে দয়া হবে না।
মারধরের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা রাজাকার রাজাকার স্লোগান দিয়েছে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করেছে। আমি প্রক্টর অফিসে ছিলাম মারধরের বিষয়ে জানি না।
শাটল ট্রেন আটকে রাখার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা শাটল ট্রেন আটকাইনি। ট্রেন কোনো যাত্রিক ত্রুটির কারণে ছেড়ে যেতে পারেনি হয়তো।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলম বলেন, গতকাল রাতে (রবিবার) কোটা আন্দোলনকারীরা আমাদের মহান স্বাধীনতার বিপক্ষে কিছু স্লোগান দিয়েছে বলে জানতে পারি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের ছেলেদের সাথে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এর সূত্র ধরেই আজকে (সোমবার) সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দুপুর আড়াইটার ট্রেন থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারীকে আমাদের কাছে নিয়ে আসে। এসময় আমরা ুুই পক্ষের কথাই শুনেছি।
তিনি বলেন, আদালত ও ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সে নির্দেশনা তাদের শুনিয়েছি। এবং এটাও বলেছি যে কেউ যদি এ নির্দেশনা মেনে না চলে তাহলে তাকে সহযোগিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
শিক্ষার্থীদের উপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একজন ছাত্র আরেকজন ছাত্রের গায়ে হাত তোলার কোনো সুযোগ নাই। এখন আমাদের কোনো ছাত্র যদি আহত হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই আমাদের কাছে অভিযোগ করবে। অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শিক্ষার্থীরা জানান, চবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শরিফ উদ্দিন ও কনকর্ড গ্রুপের অনুসারী আবিরার শাহরিয়ার নেতৃত্বে সুমন নামের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। পরে তাকে শাহ আমানত হলে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে শরিফ উদ্দিন গণমাধ্যমের কাছে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এক ছোটো ভাইকে মারধর করা হয়েছে শুনে তাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম। এটা কি অপরাধ হয়েছে আমার ?