শিক্ষাব্রতী ও সমাজদরদী আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী

3

বাসুদেব খাস্তগীর

মানুষের মধ্যে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষই প্রকৃত মানুষ। কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন নানা ভোগবিলাসকে তুচ্ছজ্ঞান করে সমাজের আপামর জনসাধারণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিবেদিত রাখার চেষ্টা করে যান প্রতিনিয়ত। বিত্ত বৈভবের এ যুগে তেমন কিছু মানুষ এখনো আছে, তখনো ছিলো, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ মন্দের পাশাপাশি ভালোদের উপস্থিতি সবসময় উজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান। হাজারো মন্দের পিছনে ভালো মানুষগুলোর ভালো কাজ আমাদের জন্য সবসময় অনুপ্রেরণার। এজন্য ভালো বা সাদা মনের মানবিক মানুষগুলো তাঁর আপন কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ অমর কীর্তিগাথা মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথের এ কথা যেন চিরন্তন সত্যের চমৎকার এক প্রকাশ। চট্টলার ফটিকছড়ি বহু প্রাজ্ঞ মনীষীর জন্মন্থান। শিক্ষা সংস্কৃতির অন্যতম পাদপীঠ এ অঞ্চলে দেশের অনেক বরেণ্য খ্যাতিমান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে ফটিকছড়িকে করেছে মহিমান্বিত। ফটিকছড়ির বুক চিড়ে বয়ে চলা হালদার কলোকলো ধ্বনি, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ মায়াময় রূপ যেন প্রকৃতির অপার দান। ফটিকছড়ি উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তে প্রকৃতির অপূর্ব লীলা নিকেতনের সমাহারে ভরপুর একটি ইউনিয়নের নাম জাফতনগর। সেই জাফতনগরের নিভৃত পল্লীর বুকে জন্মে ছিলেন তেমন মানবিকগুণ সম্পন্ন একজন মানুষ আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি জন্মগ্রহণ করে গ্রামীণ আলো বাতাসে অন্য দশ ছেলের মত বড় হয়ে উঠলেও পড়াশুনার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা বা আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করা যায়। এখানেই সেই সময়কার গ্রামের অন্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে তাঁর দর্শন ও চিন্তা ধারার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায় সেই সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা তাঁর সমসাময়িক অনেকেই পড়ালেখার পাঠ নিয়ে স্কুলের গÐিই পার হতে পারেননি। কারণ সেই সময় গ্রামীণ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা লেখাপড়া করার জন্য মোটেও অনুকূল ছিলো না। সমাজ ব্যবস্থা ছিলো খুবই রক্ষণশীল। সেই সময়ের লেখাপড়ায় অনগ্রসর সমাজ ব্যবস্থায় আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর লেখাপড়ার প্রতি আনুগত্য বা অনুরাগের প্রশংসা করতেই হয়। তৎকালীন সময়ে জাহানপুর আমজাদ আলী স্কুল থেকে এসএসসি ও এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ছিলেন আলহাজ্বমোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এটা পুরা এলাকার জন্য ছিলো অহংকারের। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে সে সময়ে তাঁর এ অর্জন এত সহজ ছিলো না। পরে তিনি নিজস্ব পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাÐেও নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাÐের মাধ্যমেই তিনি এলাকায় ধীরে ধীরে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সে জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে এলাকায় তাঁকে একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হতে সাহায্য করে। তাঁর নিজের জীবনের প্রথম দিক থেকেই একজন সৎ, বিনয়ী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবেও তিনি ছিলেন সফল একজন মানুষ । তখন থেকেই এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাএবং এর উন্নয়নে তিনি নিজেকে নিবেদিত রাখেন। তাঁর মহৎ সব মানবিক কর্মের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ ফটিকছড়ির সেই সময়কার অনগ্রসর পল্লীর বুকে এলাকার মানুষের জন্য শিক্ষার বিস্তারে তাঁর পিতার নামে ঐতিহ্যবাহী ইছাপুর বাদশা মিয়া চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা। যেটি সংক্ষেপে ইছাপুর বি এম সি কলেজ নামে পরিচিত। তাঁর অপর দুই ভাই ওমর ফারুক চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়ুব বাঙ্গালীকে সাথে নিয়ে তিনি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই কলেজ। তাঁর ছোট ভাই আয়ুব বাঙ্গালী ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১৯৬৮-৭০ সময়ের চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মানুষ যেখানে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সংকট নিয়ে জীবন জীবিকার যুদ্ধে লিপ্ত সেখানে সেখানে তখন আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী এ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটা সময়ের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত এবং চিন্তা চেতনার দিক দিয়ে অনেক দূরদর্শী। কারণ ব্যক্তি উদ্যোগে সে সময়ে কলেজ প্রতিষ্ঠা অনেকটা সাহসের ব্যাপারও ছিলো। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে মানুষ যে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিলো সে সময় আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সমাজে ছড়িয়েছে শিক্ষার আলোক বর্তিকা। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় রেখেছে অনন্য অবদান। প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসে এ প্রতিষ্ঠান সমাজে ও রাষ্ট্রে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি এলাকাকে করেছে গৌরবে অভিষিক্ত। এ প্রতিষ্ঠানের অবদান দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে দেশ বিদেশে- এ কথা নিঃসন্দেহ বলা যায়। পড়ালেখার অনগ্রর সমাজে সে সময়ে পড়াশুনা করা ইলিয়াছ চৌধুরী শিক্ষা বিস্তারে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে বাদশা মিয়া চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা এলাকার একটি ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। এটি ফটিকছড়ির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠিত কলেজ। একজন রুচিশীল মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানবিক মানুষ ছিলেন ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন, মনে প্রাণে ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের কাছে আপন করে তুলতে পেরেছিলেন। সকল মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান শ্রদ্ধার পাত্র। মরহুম আলহাজ্ব মো. ইলিয়াছ চৌধুরীরা অবিনশ্বর হয়ে থাকেন তাঁদের কীর্তির মাধ্যমেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সমাজের মানুষের কাছে আলোকবর্তিকা হয়েই আছে। আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী একজন সফল ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্বেরই নাম। যিনি শিক্ষার আলোক বর্তিকা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। শিক্ষার সর্বজনীন গুরুত্বকে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি এ ক্ষেত্রে শতভাগ সফল একজন মানুষ। আমার কলেজ শিক্ষকতা জীবনের এ সুদীর্ঘ সময়ে তাঁকে আমি একজন বন্ধুবৎসল ও অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসাবে দেখেছি এবং জেনেছি। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে আমি এ কলেজে যোগদান করি। তখন থেকেই দেখেছি তিনি কলেজের প্রায় অনুষ্ঠানে সশশীরে উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর এ উপস্থিতি আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করতো। তাঁর নানা পরামর্শে আমরা সবসময় ঋদ্ধ হয়েছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের দোর গোড়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার মানসে যে সময়ে তিনি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করেছিলেন, সে সময় এ সমাজে এরকম মানুষ ছিলো হাতেগোনা। তিনি ইচ্ছে করলে সে সময় সে টাকা বিনিয়োগ করে আরো অনেক অর্থবিত্তের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি না করে শিক্ষার কাজে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। এখানেই তাঁর মহত্ত¡। শিক্ষকদের তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। অত্যন্ত বিনয়ী ও সদালাপী মানুষ ছিলেন আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এমন সাদা মনের মানুষ আজ সমাজে বিরল। সমাজের অনগ্রসর মানুষকে অগ্রসরমান সমাজ ব্যবস্থায় তাল মিলিয়ে চলতে হলে যে পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই, তাঁর সে সময়ের চিন্তা ভাবনা সময়ের সাথে প্রমাণও দিয়েছে। ইছাপুর বাদশা মিয়া চৌধুরী কলেজ সে প্রমাণেরই অনন্য কীর্তি। দক্ষিণ ফটিকছড়িতে নারী শিক্ষা বিস্তারসহ এলাকার সামগ্রিক শিক্ষার প্রসারে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর ৬ষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকীর দিনে শিক্ষাব্রতী, সমাজদরদী কর্মবীর মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক- ইছাপুর বাদশা মিয়া চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম