শান্তির নোবেল বিজয়ীর হাত ধরে শান্তি ফিরে আসুক দেশে

4

লিটন দাশ গুপ্ত

২০০৬ সালের অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় চাকুরি থেকে এসে ড্রয়িং রুমে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ টিভির ডাউন স্ক্রোলিং এ দেখি ব্রেকিং নিউজ চলছে। দেখলাম শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আমাদের দেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন একজন বাঙালি, একজন প্রথম বাংলাদেশী তার উপর আমার চট্টগ্রাম জেলার নাগরিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন টিভিতে দেখে আনন্দে অশ্রæসিক্ত হয়েছিলাম। বলতে গেলে ঐ সময়ে আমার জীবনের এটি ছিল সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ আনন্দের সংবাদ। তখনকার সময় ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলনা। থাকলেও এই রকম ব্যাপক মানুষের হাতে হাতে ছিলনা। তাই এমন আনন্দের সংবাদ সবার আগে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের (যারা বিভিন্ন খবরা খবর রাখে) কাছে মোবাইলে জানাতে থাকি। ততক্ষণ পর্যন্ত সদ্য সংবাদটি অনেকে জানেনা। প্রথম আমার থেকে শুনে অনেকে খুশীতে উচ্ছ¡সিত হয়েছিল। সেই সময় কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ভাবলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূস (যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা) একজন অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির অধ্যাপক; কাজ করেছেন গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে, কিন্তু পুরস্কার পেয়েছেন শান্তিতে। উল্লেখ্য অর্থনীতি-সহ প্রতিবছর ছয়টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলেও তিনি কেন শান্তিতে নোবেল পেলেন তা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, অনেকে একাধিক বিষয়ে নোবেল পেয়েছেন এমন অনেক নজির রয়েছে। তাই তিনিও আরো একবার অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার পাবেন এমন ভাবনা মস্তিষ্কে এলে আরো বেশী খুশী হয়েছিলাম। যাইহোক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ব্যক্তি মাননীয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করায় স্বাভাবিকভাবে আমরা আরো একবার আনন্দে উ”চ্ছ¡সিত হয়েছি। একই সাথে আমাদের প্রত্যাশা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে দেশের চলমান হানাহানি খুনাখুনি সহিংসতা সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হবে এবং শান্তি ফিরে আসবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮শে জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ে, পরে লামা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ভর্তি হয়ে বিএ অনার্সসহ এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। প্রায় ৩ বছর শিক্ষকতা শেষে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর সেখানে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু বছর কয়েক পরে দেশপ্রেমিক ড. ইউনূস বিদেশে না থেকে নিজ দেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং এই বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এটি নতুন বিভাগ হওয়ায় তেমন বেশি কাজ ছিল না। তাই অর্থনীতি বিভাগ সাজানো ঘোচানোর পাশাপাশি তিনি সেখানকার মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা করেন। তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোতে ঘুরতে থাকেন। এভাবে ঘুরতে গিয়ে একদিন তিনি দেখতে পেলেন, এক গ্রামীণ দরিদ্র মহিলা বাঁশের তৈরী আসন বুনছিলেন। তিনি এই দরিদ্র মহিলার সাথে কথা বলে জানতে পারেন, ঐ মহিলা ঋণ পরিশোধ করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তখন ভাবছিলেন, এত সুন্দর জিনিস তৈরি করতে পারেন, তারপরেও কীভাবে এই মহিলা এত দরিদ্র হতে পারে! তখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ‘ইউরেকা মোমেন্ট’ অনুভব করেছিলেন বলে জানিয়ে ছিলেন এক পত্রিকার সাক্ষাতকারে। এরপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা এবং আশেপাশে গ্রামগুলোতে শুরু করেছিলেন একটি মাঠ পর্যায়ের গবেষণা। যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। এরপর ঐ এলাকায় তেভাগা পদ্ধতিতে কৃষকদের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের কার্যক্রম শুরু করেন। যার নাম দিয়েছিলেন ‘নবযুগ তেভাগা খামার’। এখানে তেভাগা মানে তিন ভাগকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জমি যার সে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যে বীজ ও সার দেবে সে পাবে এক ভাগ। আর যে চাষ করবে, পানি দেবে সে পাবে এক ভাগ। এভাবে শুরু হয় নবযুগ তেভাগা খামারের যাত্রা। অবশেষে কৃষকদের এই খামার থেকেই ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারনা নিয়ে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়। এরপর সমগ্র দেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আমি যখন আমার নিজ গ্রামের একটি হাইস্কুলে পড়তাম, তখন গ্রামের মহিলাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের বিষয়টি দেখে সর্বপ্রথম গ্রামীন ব্যাংকের কথা শুনেছিলাম। দেখেছিলাম পাড়ায় পাড়ায় ৫ জন করে মহিলা দল বেঁধে ঋণের জন্যে সমিতি গঠন করছে। সেই সময় গ্রামের মহাজনরা (মহাজন মানে যারা উচ্চসুদে ঋণ দিয়ে থাকে) সাধারণত স্বর্ণ বা অন্যকোন মূল্যবান দ্রব্যের বন্ধক ব্যতীত কোন প্রকার ঋণ দিতেন না। কিন্ত গ্রামীণ ব্যাংক কোন প্রকার বন্ধক ছাড়া তখনকার সময় ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে যা সাপ্তাহিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। আমার এখনো মনে আছে, সেই সময় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টাকা নেবার মানুষের এত প্রবাহ দেখে আমিও আমার মা’কে বলেছিলাম, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে অন্য কোন ব্যাংকে ৫ বছর মেয়াদে রেখে দিলে অনেক টাকা হবে, এইদিকে কিস্তির মাধ্যমে টাকাও পরিশোধ হয়ে যাবে। তখন আমার মা বলেছিল, যারা অসচ্ছল পরিবার তাদেরকে গরু ছাগল কেনার জন্যে বা ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্যে ঋণ দিচ্ছে। আমার বাবা সরকারি চাকুরী করে তাই আমাদেরকে দেবেনা।
যাইহোক, গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ভূমিহীন দরিদ্র নারীদের ঋণ প্রদান করা হয়। সাধারণত যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না, তাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে যাচ্ছে এই গ্রামীণ ব্যাংব। এই ক্ষুদ্র ঋণের সাথে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্প সহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের সেই নবযুগ খামার থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ধীরে ধীরে একপর্যায়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংক মডেলের সাফল্য, উন্নত বিশ্বসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়। এর স্বীকৃতি হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কারসহ যত সংখ্যক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, তা পত্রিকার নির্দ্দিষ্ট শব্দের নিবন্ধে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সেই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা রূপকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ তত্ত¡াবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। যদিও ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান হবার দায়িত্ব নেবার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন, তবে এবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর অনুরোধে ও দেশের কল্যাণে দায়িত্ব গ্রহণে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করে বৃহঃস্পতিবার শপথ নিয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনে সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় দুই নেত্রীকে সরাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বেশ আলোচনায় আসে। সেই সময় এমন পরিস্থিতিতে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যদিও সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একবার বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সে সময় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ ভুল ছিল। যে ভুলের খেসারত তাঁকে এখনো দিতে হচ্ছে। উল্লেখ্য ইতোপূর্বে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মহোদয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কার্যত তিন দিন দেশ সরকারশূন্য ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে, প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ জন শপথ নিয়েছেন। শপথ গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন, ‘নিষ্ঠুর স্বৈরাচার দূর হয়ে গেছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র, সুবিচার ও মানবাধিকারের, নির্ভয়ে মতপ্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সবাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। জীবনধারণের সুযোগ প্রদানের সচেষ্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও সহমর্মী পরশ দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করবেন, এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে আমরা আশ্বস্ত হলাম নতুন এক বাংলাদেশ পাব, নতুন এক বাংলাদেশ দেখব; এই প্রত্যাশায় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট