শান্তির নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের হাতে দেশ

7

পূর্বদেশ ডেস্ক

বিশ্ব যাকে চেনে ‘গরিবের ব্যাংকার’ নামে, শান্তিতে নোবেলজয়ী সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবার নিজ দেশের শাসনভার কাঁধে নিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশে যে অশান্তি চলছে, তার মধ্যেই দায়িত্ব নিলেন এই নোবেলজয়ী। প্রবল গণআন্দোলনে দেশে ক্ষমতার পালাবদলের নতুন এক অধ্যায় রচিত হওয়ার পর ‘তরুণদের দেখানো পথে’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে শপথ নিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। এই যাত্রায় উপদেষ্টা হিসেবে তার সঙ্গে থাকছেন আরো ১৬ জন।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরে গোপনীয়তার শপথ নেন ইউনূস। শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাকে অভিনন্দন জানান।
এরপর ১৬ উপদেষ্টার নাম ঘোষণা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ১৩ জন একসঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেন। শপথ নেওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী শপথ বইতে সই করেন সবাই।
যারা উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দুই তরুণ তুর্কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নাহিদ ইসলাম ও সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
তাদের মধ্যে নাহিদের বয়স ২৬, আর আসিফের ২৫। বাংলাদেশে এত কম বয়সে সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার নজির আর কারো নেই।
১৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের চারজন নারী।তারা হলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন শপথ নিয়েছেন উপদেষ্টা হিসেবে।
লেখক, রাজনীতি-বিশ্লেষক ও কলামিস্ট অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানও পেয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব।
শপথ নিয়েছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর ও সুন্নী দেওবন্দি ইসলামি পÐিত আ ফ ম খালিদ হোসেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন অনুষ্ঠানে জানান, অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক, সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় ঢাকার বাইরে থাকায় শপথ নিতে বঙ্গভবনে আসতে পারেননি।
বঙ্গভবনের দরবার হলে এই শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর কোটা সংস্কার ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘শহীদদের’ স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন সবাই।
ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর শুরু হয় শপথগ্রহণ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। সবশেষে ছিল চা পানের পর্ব।
রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, ক‚টনীতিকসহ সরকারি ও সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন প্রায় চারশ অতিথির মধ্যে।
এর আগে দুপুর ২টা ১১ মিনিটে ড. ইউনূসকে বহনকারী ফ্লাইটটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় বিমানবন্দরে ড. ইউনূসকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনীর প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
এরপর বিমানবন্দরে ড. ইউনূস বলেন, গত কয়েকদিনে দেশের মধ্যে সহিংসতা হয়েছে সেগুলো ষড়যন্ত্র। এটাকে রোধ করতে হবে। তাদের লাঠিপেটা করলে হবে না। সহিংসতাকারীদের আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। কোনো প্রকার প্রতিহিংসামূলক কাজ করা যাবে না।
তিনি বলেন, আমার ওপর যদি আস্থা এবং বিশ্বাস রাখেন তাহলে এটা নিশ্চিত করতে হবে কারো ওপর কোনো প্রকার হামলা করা যাবে না, বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। যদি বিশৃঙ্খলা করা হয় তাহলে আমি এই দায়িত্বে থাকব না।
নতুন বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন বিজয় দিবস শুরু করল উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, নতুন বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন বিজয় দিবস শুরু করল। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটি করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, তারা (সমন্বয়করা) দেশকে রক্ষা করেছে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশবাসী কাছে আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, দেশে কারও ওপর কোনো হামলা হবে না। তাহলে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি করাকে স্বাভাবিক করাকে গুরুত্ব দিয়ে ইউনূস বলেন, যেজন্য আন্দোলন হয়েছে সেটার ফলাফল যেন ব্যর্থ না হয়। পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম সে বাংলাদেশ যেন পূর্ণতা পায়। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন করে বিজয় পেল তা যেন পূর্ণতা পায়।
শপথ নিতে যেতে পারেননি তিন উপদেষ্টা : নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। গতকাল রাতে তাদের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। তবে এতে উপস্থিতি হননি তিন সদস্য। অনুপস্থিত থাকা তিন সদস্য হলেন ফান্তক-ই-আযম, বিধান রঞ্জন রায় এবং সুপ্রদীপ চাকমা।
রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন জানান, ফান্তক-ই-আযম, বিধান রঞ্জন রায় এবং সুপ্রদীপ চাকমা ঢাকার বাইরে রয়েছেন। ফলে তারা শপথ নিতে আসেননি।